ময়লার শহর গাজীপুর

.
.

ঢাকা থেকে উত্তরার আবদুল্লাহপুর পার হলেই টঙ্গী। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সীমানা এখানেই শুরু। ময়লা-আবর্জনার শুরুটাও যেন এখান থেকেই। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুই পাশ ধরে থেমে থেমে ময়লা দেখা যায় চান্দনা চৌরঙ্গীর ভাস্কর্য পর্যন্ত। আবার চৌরাস্তা থেকে শহরে যেতে শিববাড়ি সড়ক কিংবা শহরের লক্ষ্মীপুরা, দক্ষিণ ছায়াবীথি, জোড়পুকুর, হারিনাল, রেল জংশন—সবখানেই ময়লা-আবর্জনার স্তূপ।
আয়তনের দিক থেকে গাজীপুর দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন। কিন্তু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। এই সিটি করপোরেশনের আয়তন প্রায় ৩৩০ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা ৩০ লাখ। শিল্পকারখানা আছে ১ হাজার ৮৮৬টি। অথচ এত লোকের, এত কলকারখানার বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকার পর্যায়ে। নগরজুড়েই ময়লা-আবর্জনা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা এ বাস্তবতা স্বীকার করে বলছেন, গাজীপুর যেন এক আবর্জনার শহর। সামান্য বৃষ্টিতেই গাজীপুর ধরা দেয় আসল চেহারায়। বর্ষার দিনে অনেক রাস্তা ময়লা পানিতে ডুবে যায়। তাঁরা বলেন, গাজীপুরে পয়ো ও বর্জ্য সমস্যা এতটাই সীমা ছাড়িয়ে যে এ দুই সমস্যা দিনে দিনে সিটি করপোরেশনের আয়তনের মতোই বড় হয়ে উঠেছে।
গাজীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য অধ্যাপক মুকুল কুমার মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাজীপুর একটি সুন্দর শহর হবে, এটাই সবার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আমাদের সে আশা পূরণ হয়নি। সিটির বর্জ্য অসহনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ নির্বাচনের আগে সব প্রার্থী সুন্দর নগর গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।’
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মদন চন্দ্র দাস বলেন, ময়লা ফেলার জন্য স্থায়ীভাবে নিজস্ব জায়গার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত সমস্যার সমাধান হবে না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন হয় ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে। পুরোনো টঙ্গী, গাজীপুর পৌরসভাসহ ছয়টি ইউনিয়ন মিলে এই সিটি করপোরেশন। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে সিটি নির্বাচনের পর ইতিমধ্যে সাড়ে তিন বছর কেটে গেছে। কিন্তু এখনো সিটি করপোরেশন নিয়ে কোনো মহাপরিকল্পনা হয়নি। ফলে দেশের অন্যতম শিল্প-অধ্যুষিত গাজীপুরে কলকারখানা, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি গড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল ও অসম্পূর্ণ। বিশাল গ্রামীণ এলাকা এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটাকে আবাসন ও শিল্পায়নের নগর গড়ে তোলা হয়নি। পরিকল্পনার ভার ছিল রাজউকের ওপর। সীমাবদ্ধতার কারণে তারা নজর দিতে পারেনি। আবার যখন নজর দিল, তখন তারা টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভার বাধার মুখে পড়ে।

স্থানীয় অধিবাসীরা বলেন, পয়ো ও বর্জ্য সমস্যার পাশাপাশি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এবং শহরের রেলক্রসিং এলাকার প্রতিদিনকার যানজট নগরবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিশেষ করে শিববাড়ি থেকে রাজবাড়ী যেতে রেলক্রসিংয়ে শহরবাসীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। এর প্রভাব পড়ে শহরের অন্য সড়কেও। নির্বাচনের আগে রেলক্রসিংয়ে উড়ালসড়ক নির্মাণ ও বাইপাস সড়ক করে যানজট নিরসন করার প্রতিশ্রুতি ছিল প্রধান দুই প্রার্থীর। কিন্তু এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বাস্তব কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী (পরে সরে দাঁড়ান) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি তো বলি, গাজীপুর হচ্ছে দীর্ঘতম ময়লার শহর। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর, সেখান থেকে কোনাবাড়ি—ময়লা আর ময়লা। গাজীপুরকে নিয়ে আমার বড় স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বর্তমান অবস্থা দেখে আমি হতাশ। মানুষকে ভোগান্তির শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছে।’

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, বর্জ্য পরিবহনে করপোরেশনের ১২টি গাড়ি আছে। এর মধ্যে চারটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল। বর্জ্য ফেলার জন্য সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। এ জন্য ১০০ বিঘা জমি কিনতে সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছে করপোরেশন। কিন্তু এখনো অনুমতি পাওয়া যায়নি। অস্থায়ীভাবে চান্দনা চৌরাস্তা, মালেকের বাড়ি, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তাসহ বিভিন্ন জায়গায় ময়লা ফেলা হচ্ছে। পরে সেগুলো কড্ডায় নেওয়া হয়।

নির্বাচিত মেয়র এম এ মান্নান বরখাস্ত হওয়ার পর গত বছরের মার্চে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হয়েছেন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর আসাদুর রহমান। শহরের ময়লা-আবর্জনার বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ঠিক যে বর্জ্য গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একটা প্রধান সমস্যা। ডাম্পিংয়ের জন্য আমাদের এক ইঞ্চি জায়গাও নেই। জমি কেনার জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।’

জানা গেছে, বর্তমানে সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ (নর্দমা) ব্যবস্থা কেমন বা কতটা কাঁচা, কতটা পাকা—এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই করপোরেশনে। সেখানকার দায়িত্বশীল একজন প্রকৌশলী বলেন, সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত ছয়টি ইউনিয়নে খাল-বিল ছাড়া কোনো ড্রেনেজ-ব্যবস্থা নেই। এ বিষয়ে তথ্য নিতে সম্প্রতি পাঁচ সদস্যের সার্ভে টিম করা হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনের পর গত সাড়ে তিন বছরে করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকার সড়ক ও ড্রেন নির্মাণে প্রায় সাড়ে তিন শ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত মেয়র বলেন, তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার পর ১০ মাসে ৩০০ কোটি টাকার দরপত্র হয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা জাইকা ও সিটি করপোরেশন এর অর্থায়ন করেছে। দরপত্রের ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশন ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া সরকার সিটি করপোরেশনকে ২০ কোটি টাকার উন্নয়ন ও ২০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছে এ বছর। এর বাইরে সম্প্রতি ৬৬০ কোটি টাকার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে সিটি করপোরেশন।

কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে মনে করছেন, সব উন্নয়নই যেন ময়লা-আবর্জনার মতো নানা নাগরিক দুর্ভোগে ঢাকা পড়েছে। পুরোনো টঙ্গী ও গাজীপুর পৌর এলাকায় কিছু নাগরিক সুবিধা আছে। কিন্তু কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, গাছা, পুবাইল, কাউলতিয়া ও বাসন ইউনিয়নের সিংহভাগ এলাকা এখনো খাল-বিল আর কৃষিজমি। এসব ইউনিয়নের রাস্তাঘাট ভালো না। সেখানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে আবাসন ও শিল্পকারখানা।

বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশন অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করেন সিটি করপোরেশনের শহর পরিকল্পনাবিদ সানজিদা হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এ সমস্যার সমাধানে নজর দিয়েছি।’

নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নিয়ে মানুষের বিপুল আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল। যার প্রকাশ ঘটেছিল বিগত সিটি নির্বাচনে। কিন্তু সাড়ে তিন বছরের মাথায় মানুষের আগ্রহে ভাটা পড়েছে।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ছয় ইউনিয়নের গ্রামগুলো অন্তর্ভুক্ত করায় আয়তনের দিক থেকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন সবচেয়ে বড়। কিন্তু গ্রামে গ্রামে সেবা দেওয়া কোনো সিটি করপোরেশনের পক্ষেই সম্ভব নয়। ফলে ছয় ইউনিয়নে কার্যত কোনো সেবা নেই। তারা না পাচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের সেবা, না পাচ্ছে সিটি করপোরেশনের।

তোফায়েল আহমেদের মতে, একদিকে নির্বাচিত মেয়র নেই। বিরোধীদলীয় কাউন্সিলররাও গুরুত্ব পাচ্ছেন না। আবার করপোরেশনে যে সম্পদ ও জনবল আছে, তা দিয়ে এত বিশাল সিটিকে সেবা দেওয়া অসম্ভব। এখন রাস্তাঘাট মেরামত, নির্মাণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা—সবকিছু সমন্বিতভাবে করার জন্য পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।

নির্বাচিত মেয়র এম এ মান্নান প্রায় ২২ মাস ধরে দায়িত্বে নেই, তিনি সাময়িকভাবে বরখাস্ত। তাঁর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমানের বিরুদ্ধে সড়কের নির্মাণ ও বিভিন্ন উন্নয়নকাজে দুর্নীতির অভিযোগ করছেন অনেকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন নিয়ে মান্নানের কোনো মহাপরিকল্পনা ছিল না। আর তাঁকে ফাঁসিয়ে যিনি ভারপ্রাপ্ত মেয়র হয়েছেন, তাঁর মধ্যে লুটপাটের মানসিকতা আছে। তিনি কাউন্সিলর থেকে মেয়র হয়ে বাড়িগাড়ি করেছেন, মাসে মাসে বিদেশ ভ্রমণ করছেন।

অবশ্য আসাদুর রহমান এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখানে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। যাঁরা বলছেন, তাঁরা প্রতিহিংসা থেকেই বলছেন।

গাজীপুরের পেশাজীবী, রাজনীতিক ও বাসিন্দাদের কারও কারও অভিমত, নির্বাচিত মেয়র দায়িত্বে না থাকায় সিটি করপোরেশন কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। করপোরেশনের বর্তমান নেতৃত্ব দুর্বল। এ কারণে ঢাকার পাশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিটির উন্নয়নে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোও ততটা উৎসাহী নয়। এ জন্য বরখাস্ত মেয়র ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র—দুজনেরই দায় আছে।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে পরাজিত প্রার্থী ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা খুব দুর্বল। এ ক্ষেত্রে মেয়রের (এম এ মান্নান) ব্যর্থতা রয়ে গেছে। করপোরেশনের উন্নয়নে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোকে আকৃষ্ট করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। তিনি ১৮ মাস ছিলেন। কোনো দাতাকে আনতে পারেননি।

ভারপ্রাপ্ত মেয়রের প্রতি ইঙ্গিত করে আজমত উল্লাহ বলেন, মেয়র ও ভারপ্রাপ্ত মেয়রের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য আছে। দাতা সংস্থাগুলো তাদের কাছে আস্থাভাজন হলেই কেবল টাকা দেয়।

এম এ মান্নান দাবি করেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনো কাঠামো ছিল না। তিনি দায়িত্ব নিয়ে কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন। ৮০ কোটি টাকার দরপত্র দিয়েছেন। জাইকার অর্থায়নে ১৯০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন ছিল। এরপর চর দখলের মতো সিটি করপোরেশন দখল করা হয়েছে।

নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, শিল্পকারখানার কারণে ঢাকার চেয়েও গাজীপুরে জনসংখ্যার চাপ বেশি। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশনের বৈজ্ঞানিক ও মানসম্মত নগর-পরিকল্পনা দরকার এবং এর বাস্তবায়নের জন্য সুদক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন।