যত বোকা মনে হয়, গরু এত বোকা না
গ্রিন রোডে হঠাৎ হাতের ভেতর থেকে দড়ি ফসকে দৌড় দিয়েছে এক কালো গরু। যদিও রিকশা আর মানুষের ভিড়ে তিন থেকে চার হাতের বেশি যাওয়া হলো না এ যাত্রায়। সবে এক মিনিট্রাকে এনে নামানো হয়েছিল। সুযোগ বুঝেই ছুট।
ফিরিয়ে এনে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে চায়না ঘাস আর কাঁঠালের পাতা ঘুষ দেওয়ার পরও দেখলাম, সালসা নাচের প্রস্তুতির মতো মাটিতে পা ঘষেই চলেছে সে। রাগে গজ গজ করতে করতে ডাকল খানিকক্ষণ। ঠিক তখন একটা শব্দ শুনলাম...বেআক্কেল। উদ্দেশ্য গরু, নাকি দড়ি সামলাতে না পারা যুবক, বোঝা গেল না।
কে বেআক্কেল জানতে, তা চাইলে ঘাড় ঘুরিয়ে আঁকাবাঁকা দাঁতের প্রদর্শনী দিয়ে চালক ভাই বললেন, ‘আরে আপা, ওই ব্যাটা একটা বেআক্কেল। গরুর দড়ি ধইরা নিজে হাঁটতেছে আগে আগে। গরুরে রাখতে হয় সামনে। ওর মাথার ভেতর স্মৃতি আছে, মালিক থাকবে পেছনে। পেছনে থাকা মানে যেকোনো সময় লাঠির বাড়ি আসতে পারে। আর যদি সামনে সামনে কেউ হাঁটে, তাইলে গরুর হঠাৎ সব আউলায় যায়। সে চোখেও কম দেখে। আরে, সামনে আগাইতে হইলে তো রাস্তাও দেখা লাগবে, নাকি? গরু পিছন থিকাও লাথি দেয়। গরুরে যত বোকা মনে হয়, গরু এত বোকা না। বেআক্কেল লোজজন দুই দিনও একটা গরুর যত্ন নিতে পারে না। খালি খাওয়াইলেই হয় না।’
এমন জ্ঞানগর্ভ আলোচনার মধ্যে বেরসিক সিগন্যালটা ছেড়ে দিল। হঠাৎ ঘটনার আকস্মিকতায় যে প্রবাহে কথা বলছিলেন, সে প্রবাহ থাকবে না বুঝে একটু খারাপই লাগল। কিন্তু গরু নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় আমার আগ্রহ তখন আরও বাড়ছে।
প্রতিবছর এই প্রাণীটা কয়েক দিনের জন্য আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে। তাদের উপস্থিতিতে যেমন শহরের পথ আর বাড়ির বারান্দা বা গ্যারেজে চেহারা বদলে যাচ্ছে, তেমনি আমাদের সন্তানেরাও কয়েক দিনের জন্য হয়ে উঠছে আরও একটু মানবিক। এর সঙ্গে উঠে আসছে এই প্রাণীদের নিয়ে নানা রকম তথ্য–ছবির গল্প। দশমণি বা কালা পাহাড়রা বিক্রির আগে আদর করছেন ওর মানুষ পিতাকে। বাড়ি থেকে আনার সময় শিশুটি আঁকড়ে রেখেছে প্রিয় গরু টিকে। অথবা পশুর হাটে গরুর পাশেই শুয়ে আছেন ক্লান্ত ব্যাপারী। বেচা শেষ হলে খালি ট্রাকে উঠে ঈদের দিন বাড়ি ফিরবেন তাঁরা।
সিগন্যাল ছাড়ার পর রিকশাচালকের কাছে জানতে চাইলাম, ‘গরুর সামনে বা পেছনে থাকার এসব মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আপনি কেমন করে জানেন? আপনার গরু ছিল?’
বিক্রমপুরের রুহুল আমিন রাজধানীর মৌসুমি রিকশাচালক। সওয়ারির কাছ থেকে হয়তো প্রত্যাশা করেননি এ প্রশ্ন। তারপরও বললেন, ‘গরুর জন্যই তো রিকশা চালাইতে ঢাকা শহরে আসছি।’ জানালেন, তাঁর পোষা গরু গত বছর ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। সেখান থেকে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে আরেকটা গরু কিনেছেন। রুহুল আমিনের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মেয়ে সে গরুর নাম রেখেছে শেফালি। শেফালির দুটো ছেলেমেয়ে হয়েছে। একজনের নাম সীমা। ছেলেটার এখনো নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুজনই এখনো মায়ের দুধ খায়।
আগের গরু বিক্রির বাকি ২০ হাজার টাকার সঙ্গে আরও কিছু পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিলেন দরজির দোকান। করোনার জন্য সে দোকান লাটে ওঠায় বিপাকে পড়েছে রুহুল আমিন। এর মধ্যে ধারদেনা হয়েছে কিছু। ভেবেছিলেন, গরুটা বিক্রি করে আবার নতুন কিছু শুরু করবেন।
রুহুল আমিন তাহলে ঢাকায় কী করছেন? জানালেন, প্রতিদিন ১১০ টাকা মালিককে দিয়েও এখন তাঁর ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা থেকে যায় রিকশা চালিয়ে। তিন মাস হলো রিকশা চালাচ্ছেন। আর কিছু টাকা জমলেই তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন।
গল্প করতে করতে আমি প্রায় অফিসের কাছে পৌঁছে গিয়েছি। ভাড়া মেটাতে মেটাতে জানতে চাইলাম, কেন বিক্রি করেননি তাহলে?
রুহুল আমিন জানালেন, তাঁর একমাত্র মেয়ে গরুর সঙ্গে গল্প করে, এটা-সেটা দিয়ে সাজায়। ছোট বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বিকালবেলা খেলার মাঠে যায়। গরুর বাচ্চারা দাঁড়িয়ে থাকে একপাশে। মাঝেমধ্যে ছুটে মাঠের মধ্যে চলে গেলে রুহুল আমিনের মেয়ে ধমকে দেয়। গরুরা আবার মাঠের পাশে গিয়ে বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সংসার চালানো কঠিন হয়েছে রুহুল আমিনের জন্য। আবার গরু বেচে নতুন কিছু শুরুও করতে পারছেন না। তাই জীবিকার জন্য মৌসুমি রিকশাচালক হয়ে ঠাঁই নিয়েছেন এ শহরে।
তবে মেয়ের সঙ্গে রোজ কথা হয় রুহুলের। বাবা ভাত খেয়েছে কি না জানতে মিসড কল দেয় রুহুল আমিনের মেয়ে। তখন সে গরুগুলোর ‘আপডেট’ জানায় বাবাকে।
রুহুল আমিন ঢাকায় একটি মেসে থাকেন, যেখানে এক রুমে ছয় বাসিন্দা। দিনপ্রতি খাবারের জন্য ১০০ টাকা নির্ধারিত। থাকার জন্য মাসে এক হাজার টাকা করে দেন। এই আর কয়েক দিন পরই ফিরে যাবেন বাড়িতে। এত খবর শুনতে শুরুতে বলি, ‘ঢাকা শহরে এত কষ্ট করছেন, গরু বিক্রি করে আবার নতুন কোনো ব্যবসা তো শুরু করতেই পারেন। আরও দুটো গরু তো এখন আছেই আপনার।’
বিক্রমপুরের রিকশাচালক রুহুল আমিন আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে উত্তর দিলেন, ‘কী বলেন আপা! চোখের সামনে না দেখলে মায়েরে খুঁজবে না? শেফালির বাচ্চা দুইটা এখনো দুধ খায়। মায়েরে বিক্রি করলে বাচ্চা দুইটা মনে কষ্ট পাবে না?’ রুহুল আবারও মনে করিয়ে দিলেন, ‘যত বোকা মনে করেন, গরু কিন্তু তত বোকা না।’