যেখানে শহীদ হয়েছিলেন জহির রায়হান

মিরপুর ১২ নম্বর ডি ব্লকের মুসলিম বাজার ঢালের পশ্চিমে ওয়াসার পানির ট্যাংক। দক্ষিণ দিকে বায়তুল আযমত জামে মসজিদ। আর উত্তর ও পূর্ব দিকে অসংখ্য ছয়-সাততলা ভবন। পানির ট্যাংক ও মসজিদের প্রবেশপথের একটু আগে ওয়াসার পানির ট্যাংকের দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে কয়েকটি চায়ের টং দোকান। জায়গাটি ‘১২ নম্বর পানির ট্যাংক’ হিসেবে পরিচিত।
এই দেয়ালের সামনে ১৯৭২ সালে ৩০ জানুয়ারি সকালবেলা শহীদ হয়েছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক-সাংবাদিক জহির রায়হান।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রকাশিত মিরাজ মিজু রচিত ‘মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি’ শীর্ষক পুস্তিকা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
ওই সূত্রমতে, ১২ নম্বর পানির ট্যাংক থেকেই টেনেহিঁচড়ে তাঁর লাশ নিয়ে গুম করে ফেলা হয়। শুধু জহির রায়হান একা নন, তৎকালীন ঢাকা জেলার প্রথম পুলিশ সুপার জিয়াউল হক খান লোদীসহ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর শতাধিক কর্মকর্তা, সৈন্য সেদিন শহীদ হয়েছিলেন বিহারিদের আক্রমণে। বিহারিদের সঙ্গে সে সময় কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যও অংশ নেয়।
‘মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি’ শীর্ষক পুস্তিকা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানমতে, শতাধিক লাশ কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলে দেওয়া হয় বিভিন্ন স্থানে। এসব হাড়গোড় মুসলিম বাজার বধ্যভূমির (বর্তমানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জামে মসজিদ) কুয়ার ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় ১৯৯৯ সালের ২৭ জুলাই। যেগুলো এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
জহির রায়হানকে হত্যার পরদিন ৩১ জানুয়ারি মিরপুর বিহারি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলমুক্ত হয়।
মিরপুরে শহীদ হলেও জহির রায়হানের হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়াটা দুঃখজনক বলেন মন্তব্য করেন তাঁর ছেলে অনল রায়হান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জহির রায়হানের হত্যার কোনো তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তাঁর গাড়িটিও ঘটনার কয়েক দিন পর পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় রমনা এলাকায়। সেসব বিষয় খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহু অনুসন্ধানের পরে জহির রায়হানের জীবনের শেষ মুহূর্তের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর খোঁজ আমরা পেয়েছি। তাঁর শহীদ হওয়ার আগে-পরের বিবরণ আমরা তাঁদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি।’
১৯৯৯ সালে দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায় জহির রায়হানকে মিরপুরের ১২ নম্বর সেকশনের এই স্থানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছেন, এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি দিয়ে সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকা​শিত হয়েছিল।

যেভাবে শহীদ হন জহির রায়হান
মিরপুর ১২ নম্বর পানির ট্যাংকের ঢালে নিহত হওয়ার ঘণ্টা খানেক আগে জহির রায়হানের সঙ্গে পরিচয় হয় সেনাবাহিনীর তৎকালীন ১২ নম্বর প্লাটুন কমান্ডার 

মোখলেছুর রহমানের। মোখলেছুর রহমানের বয়স তখন ৩৪ বছর। 

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ

গত সোমবার বিকেলে জহির রায়হানের মৃত্যুস্থলে তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।
সেখানে দাঁড়িয়ে এই অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি কোরবানির ঈদের দিন বিকেলে জহির রায়হান এসেছিলেন রমনার রেসকোর্সে ৩ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তরে। অবরুদ্ধ মিরপুরে সেনা অভিযান হবে জানতে পেরে তিনি জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে আলোচনা করেন। জহির রায়হান সেখানে বলেন, তিনি খবর পেয়েছেন মিরপুরে তাঁর ভাই শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরীসহ আরও অনেককে বিহারিরা আটকে রেখেছে। এ সময় জহির রায়হানকে বলা হয়েছিল, তিন দিন পর অভিযান হবে। তখন আসতে হবে। পরে ২৯ জানুয়ারি মিরপুর টেকনিক্যালে আসেন জহির রায়হান। এ সময় ৩০ জানুয়ারি সকালে মিরপুরে অভিযান চালানোর কথা জানানো হয় জহির রায়হানকে। সেদিন সকাল সাতটার দিকে জহির রায়হান তাঁর চাচাতো ভাই বর্তমানে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবিরসহ আরও কয়েকজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন।
৩০ জানুয়ারি সকাল পর্যন্ত জহির রায়হান বা শাহরিয়ার কবিরকে চিনতেন না মোখলেছুর রহমান। শাহরিয়ার কবির ফিরে গেলেও জহির রায়হান সেনাবাহিনী ও পুলিশের বহরের সঙ্গে মিরপুর ১২ নম্বরের দিকে যান। অভিযানে তিনিই ছিলেন একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি।
সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ১২ নম্বর পানির ট্যাংকের সামনে মোখলেছুর রহমানের সঙ্গে জহির রায়হানের পরিচয় করিয়ে দেন অভিযানের কমান্ডার কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) মইনুল হোসেন চৌধুরী। জহির রায়হানের পরনে ছিল ক্রিম কালারের সোয়েটার ও ছাই রঙের ফুলপ্যান্ট।
কর্নেল মইনুল এ সময় জহির রায়হানের সঙ্গে দুজন সেনাসদস্য রাখার নির্দেশ দেন মোখলেছুর রহমানকে। তখন তিনি সিপাহি আমির হোসেন ও সিপাহি আকরামকে জহির রায়হানের 

সঙ্গে দেন। এর পর মোখলেছুর রহমান তাঁর বহর নিয়ে পূর্বে বিলের দিকে চলে যান। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিহারিরা পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে কালাপানি পানির ট্যাংকের সামনে সেনা ও পুলিশ সদস্যদের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। সে সময় ওই এলাকায় টিনের প্রচুর ঝুপড়ি ঘর ছিল। এসব ঘরে ছোট ছোট ফুটো করে বন্দুক দিয়ে গুলি চালায় বিহারিরা। এর নেতৃত্ব দেয় মিরপুরের কসাই বলে পরিচিত আকতার গুন্ডা।
আক্রমণের খবর পেয়ে ১২ নম্বর কালাপানি ট্যাংকের সামনে নিজের দল নিয়ে আসেন মোখলেছুর রহমান। বিহারিরা যে এতটা শক্তিশালী ছিল, এটি তাঁর ধারণার বাইরে ছিল।
পানির ট্যাংকের সামনে দেয়ালের পাশে জহির রায়হানের রক্তাক্ত লাশ দেখতে পান তিনি। তখন সময় বেলা ১১টা হবে। দেয়ালের উল্টো দিকে এসপি জিয়াউল হক খান লোদীসহ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর শতাধিক কর্মকর্তা, সৈন্যের লাশ পড়েছিল। তবে মোখলেছুর রহমানসহ সেনাসদস্যদের দেখে আবারও গুলিবর্ষণ করতে থাকে বিহারিরা। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে চলে আসতে বাধ্য হন তাঁরা। সেনাসদস্যরা চলে যাওয়ার পর জহির রায়হানসহ অন্যদের লাশ গুম করে বিহারিরা। পরদিন ৩১ জানুয়ারি আবারও অভিযান চালিয়ে মিরপুর বিহারিদের দখলমুক্ত হলেও লাশ পাওয়া যায়নি।

রাজধানীর মিরপুর ১২ নম্বরের কালাপানি পানির ট্যাংকের এই স্থানে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের মরদেহ পড়ে ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানান। ছবি :  জাহিদুল করিম
রাজধানীর মিরপুর ১২ নম্বরের কালাপানি পানির ট্যাংকের এই স্থানে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের মরদেহ পড়ে ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানান। ছবি : জাহিদুল করিম

এ ব্যাপারে সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‌‌‘জহির রায়হানের সঙ্গে আমি ৩০ জানুয়ারি মিরপুর ৬ নম্বর আর্মি ক্যাম্প পর্যন্ত ছিলাম। ওখানে জেনারেল শফিউল্লাহ ও মইন ছিলেন। অভিযানে বেসামরিক ব্যক্তিদের চলে যেতে হবে বলা হলে আমি ফিরে আসি। কিন্তু বিহারিদের হাতে শহীদুল্লা কায়সারসহ অনেকে আটক আছে জানালে জহির রায়হান সেনাবহরের সঙ্গে অভিযানে যান। আমার পরিষ্কার মনে আছে, জহির রায়হানের পরনে ছিল সোয়েটার ও প্যান্ট। বেসামরিক ব্যক্তি তিনি একাই ছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক যে বধ্যভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতিচিহ্ন কিছুই নেই।’