যেনতেন কলেজও জাতীয়করণ হচ্ছে

জাতীয়করণের দাবিতে গতকাল বরিশালের উজিরপুর বিএন খান কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা মিছিল বের করেন l ছবি: প্রথম আলো
জাতীয়করণের দাবিতে গতকাল বরিশালের উজিরপুর বিএন খান কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা মিছিল বের করেন l ছবি: প্রথম আলো

বেসরকারি কলেজ ও বিদ্যালয় জাতীয়করণে আর্থিক লেনদেন, তুলনামূলক ভালো ও পুরোনো কলেজকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত নতুন কলেজকে জাতীয়করণ করাসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এমপিওভুক্ত (বেতন বাবদ মাসিক সরকারি অনুদান) না হওয়া কলেজও জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে মাত্র এক বা দুজন পরীক্ষা দেয় এমন কলেজও আছে তালিকায়।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করে দেশের অন্তত ২০টি উপজেলায় অনিয়ম ও বৈষম্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর প্রতিবাদে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে। টাঙ্গাইলের গোপালপুরে হরতালও পালিত হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, জাতীয়করণের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা তৈরি হয়েছিল, এতে কিছু শর্ত দেওয়া ছিল। কিন্তু সব ক্ষেত্রে শর্ত মানা হচ্ছে না। ফলে যেনতেন কলেজও জাতীয়করণ হচ্ছে।
যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, দেখেশুনে মনে হচ্ছে, জাতীয়করণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য পেয়েছে। এতে শিক্ষার কোনো উন্নতি হবে না। তিনি বলেন, যদি শিক্ষার মান বাড়ানোই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সেটা পরিষ্কার করে বলতে হবে, কীভাবে সেটি করা হবে। তাঁর প্রশ্ন, এত কলেজ জাতীয়করণ হচ্ছে, কিন্তু এগুলো দেখার মতো সক্ষমতা আছে কি?

দেশে এখন সরকারি কলেজের সংখ্যা ৩৩৫। সরকারের সিদ্ধান্ত হচ্ছে সরকারি কলেজ নেই এমন ৩১৫টি উপজেলায় বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ করা। ইতিমধ্যে জাতীয়করণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দুই ধাপে ১৯৯টি বেসরকারি কলেজের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এগুলো যুক্ত হলে সরকারি কলেজের সংখ্যা হবে ৫৩৪। পরের ধাপে আরও শতাধিক কলেজ জাতীয়করণ হলে এই সংখ্যা হবে ৬৫০, যা বিদ্যমান সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। এর বাইরে ৭৯টি মাধ্যমিক স্কুলও জাতীয়করণ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কিসের ভিত্তিতে স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ ক
রা হচ্ছে—প্রথম আলোর এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী যেসব উপজেলায় কোনো সরকারি স্কুল ও কলেজ নেই, সেগুলোতে একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারি করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানোর পর সেখান থেকেই তালিকা করে দেওয়া হয়েছে। এখন এগুলো পরিদর্শন করে চূড়ান্ত করা হবে।

শিক্ষা ক্যাডারের কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করেন, বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতি করে বেসরকারি কলেজে অযোগ্য লোককেও শিক্ষক করা হয়েছে। অপর দিকে সরকারি কলেজের শিক্ষকেরা বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগ পান। এখন হঠাৎ করে এত বিপুলসংখ্যক কলেজ জাতীয়করণ করায় ওই সব কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব বাড়বে। লেখাপড়ার ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

জানতে চাইলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি আই কে সেলিমুল্লাহ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার সম্প্রসারণে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং এই চাপ বহন করার মতো প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা শিক্ষা প্রশাসনের নেই। এর ফলে কলেজ শিক্ষায় নানা রকম ঝুট-ঝামেলা সৃষ্টি হবে, এর প্রভাব পড়বে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকের ওপর।’

দৃষ্টান্ত হিসেবে ওই শিক্ষকনেতা বলেন, প্রায় ১০০ সরকারি কলেজে গত ৩০ বছরে এনাম কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ওই সব কলেজে লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষা প্রশাসন সেদিকে নজর দিতে পারছে না। তা ছাড়া সামগ্রিকভাবে কলেজে শিক্ষার মান ও পরিবেশ ভালো নয়। এসব দিকেও নজর দেওয়ার কথা ভাবতে হবে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ডিগ্রি কলেজকে বাদ দিয়ে উপজেলা থেকে দুই কিলোমিটার দূরের অন্য একটি কলেজকে জাতীয়করণ করা হচ্ছে। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ থেকে ২০১৪ সালে মাত্র দুজন পরীক্ষা দিয়ে দুজনই ফেল করে। ২০১৫ সালে একজন পরীক্ষা দিয়ে একজন পাস করে।

জাতীয়করণের তালিকায় থাকা মাগুরার মহম্মদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান কলেজ এমপিওভুক্তই হয়নি। পাঠদান শুরু হয়েছে ২০১২ সালে। সরেজমিনে দেখা যায়, ফাঁকা মাঠের মধ্যে কলেজটি স্থাপিত। কলেজের আশপাশে খেতখামার, ডোবা। কলেজের সীমানা ঘেঁষে পাট চাষ করা হয়েছে। এখানে শুধু উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানো হয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে এখন পর্যন্ত ১০০ জন ভর্তি হয়েছে, আর দ্বাদশ শ্রেণিতে ১০৬ জন শিক্ষার্থী। চলতি বছর ৮৯ জন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। অথচ এই উপজেলার ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আমিনুর রহমান কলেজে ১ হাজার ৪০০ জন শিক্ষার্থী। কিন্তু কলেজটি জাতীয়করণের তালিকায় নেই।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশেও এমপিওভুক্ত নয় এমন একটি কলেজকে জাতীয়করণের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। অথচ ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত তাড়াশ ডিগ্রি কলেজ জাতীয়করণের তালিকায় নেই। সেখানে শিক্ষার্থী প্রায় দুই হাজার। পাঁচ বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয়। কলেজটির ‍উপাধ্যক্ষ হোসনে আরা বলেন, এত পুরোনো কলেজ, অবকাঠামোও পর্যাপ্ত, তারপরও এই কলেজকে বাদ দেওয়া হলো।

টাঙ্গাইলের বাসাইলে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত জোবেদা রুবেয়া মহিলা কলেজও তালিকায় রাখা হয়েছে। এই কলেজও এমপিওভুক্ত হয়নি। অথচ পুরোনো এমদাদ হামিদা ডিগ্রি কলেজকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজকে বাদ দিয়ে নন-এমপিওভুক্ত সাইফুর রহমান কলেজ জাতীয়করণ করা হচ্ছে।

জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সরিষাবাড়ী কলেজকে বাদ দিয়ে নতুন একটি কলেজকে জাতীয়করণ করা হচ্ছে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের এই কলেজ ৩৪ শতক সরকারি খাসজমিতে স্থাপিত। এমপিওভুক্ত হয় ২০১০ সালে। শিক্ষার্থী ১৩৫ ও শিক্ষক ১৬ জন। অথচ সরিষাবাড়ী কলেজে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক (পাস) ও স্নাতক (সম্মান) মিলিয়ে শিক্ষার্থী প্রায় চার হাজার। সরিষাবাড়ী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছরোয়ার জাহান বলেন, সব যোগ্যতা থাকলেও জাতীয়করণ হয়নি তাঁদের কলেজ।

টাঙ্গাইলের গোপালপুরে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত গোপালপুর কলেজকে বাদ দিয়ে মেহেরুননেছা মহিলা কলেজকে জাতীয়করণ করা হচ্ছে। এই কলেজের অন্যতম উদ্যোক্তা ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি বিএনপির নেতা আবদুস সালাম।

রাজশাহীর পুঠিয়ার লস্করপুর মহা বিদ্যানিকেতন কলেজটির জমি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গেজেটভুক্ত। প্রতিষ্ঠার সময়সহ শিক্ষার বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে থাকলেও বগুড়ার সারিয়াকান্দি ডিগ্রি কলেজ (১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত) বাদ দিয়ে জাতীয়করণ হচ্ছে স্থানীয় সাংসদের নামে করা ‘সারিয়াকান্দি আবদুল মান্নান মহিলা কলেজ’।

দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলা সদর বাদ দিয়ে উপজেলা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরের জয়ানন্দ ডিগ্রি কলেজকে জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সেখানে আন্দোলন চলছে। অথচ এই কলেজের ১০ কিলোমিটার পূর্বে বীরগঞ্জ পৌর এলাকায় বীরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ এবং ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বোচাগঞ্জ উপজেলার সেতাবগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের নাম জাতীয়করণের তালিকায় আছে। আর ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে একই রাস্তার পাশে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ সরকারি কলেজ রয়েছে। বৈষম্য ও অনিয়মের এ রকম আরও উদাহরণ আছে।

নীলফামারীর ডিমলা মহিলা কলেজ জাতীয়করণ করায় তার চেয়ে পুরোনো ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজকেও জাতীয়করণের দাবি উঠেছে। বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহি ও পুরানো ফকিরহাট কলেজকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত নতুন একটি কলেজ জাতীয়করণ হচ্ছে। এ ছাড়া বরিশালের বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট, পিরোজপুরের নাজিরপুর, মৌলভীবাজারের বড়লেখা, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জাতীয়করণ নিয়ে আন্দোলন চলছে।

টাকা লেনদেন: বিভিন্ন এলাকায় কলেজ জাতীয়করণের জন্য স্থানীয় কয়েকজন সাংসদ ও সরকারদলীয় নেতাদের মাধ্যমে শিক্ষকদের টাকা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এখন যেসব কলেজ জাতীয়করণ করার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে, সেসব কলেজের শিক্ষকেরা টাকা দিচ্ছেন জাতীয়করণের শেষ ধাপের প্রক্রিয়া শেষ করতে। দ্বিতীয়ত, যেসব স্কুল-কলেজ এখনো জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত হতে পারেনি, সেগুলো তালিকায় নাম ওঠাতে টাকা দিচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আর্থিক লেনদেন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যেসব স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা লেনদেন করছেন, তাঁরা নির্বোধ। কারণ, এ কাজে কোনো টাকা লাগে না।

এদিকে কলেজগুলো পরিদর্শন করতে ৩০ জুন মাউশিকে নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাউশির মহাপরিচালক শেখ মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, তাঁরা দ্রুত পরিদর্শন করে মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দেবেন।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন রাজশাহীর আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, দিনাজপুরের আসাদুল্লাহ সরকার, বগুড়ার আনোয়ার পারভেজ, কুষ্টিয়ার তৌহিদী হাসান, নীলফামারীর মীর মাহমুদুল হাসান, মাগুরার কবির হোসেন, টাঙ্গাইলের কামনাশীষ শেখর, সিরাজগঞ্জের এনামুল হক ও সরিষাবাড়ী (জামালপুর) প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম)।