যে গ্রামের মানুষ বছরে ছয় মাস যাযাবর
গ্রামটিতে বাস করে তিন শতাধিক পরিবার। লোকসংখ্যা দুই হাজারের মতো। কিন্তু তারা সেখানে থাকতে পারে বছরে ছয় মাসের মতো। বাকি ছয় মাস বসতভিটা ছেড়ে তারা হয়ে পড়ে একরকম যাযাবর।
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার এই গ্রামটির নাম কাশিপুর। এই গ্রামের মানুষের দুরবস্থা প্রায় ২৭ বছর ধরে। ধন নদের তীরবর্তী গ্রামটি রক্ষায় যে বাঁধ ছিল তা ভেঙে যায় ১৯৮৮ সালের বন্যায়। এরপর আর তা মেরামত করা হয়নি। তখন থেকে প্রতিবছর বর্ষায় গ্রামটি ডুবে যায় সাত-আট ফুট পানির নিচে। এ সময় গ্রামের একটি বাদে সব পরিবার চলে যায় গ্রাম থেকে, আশ্রয় নেয় আশপাশের কোনো উঁচু গ্রামের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের দিকে গ্রামে ফিরে অস্থায়ী ঘর বাঁধে তারা। শুরু করে চাষাবাদ।
কাশিপুর গ্রামটি নিকলী সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ধন নদের দক্ষিণ-পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। পড়েছে সিংপুর ইউনিয়নের মধ্যে। ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, গ্রামটির বাসিন্দাদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কৃষক, ৪০ শতাংশ ভূমিহীন ও ১৫ শতাংশ বর্গাচাষি। গ্রামের লোকজনের যোগাযোগের একমাত্র বাহন নৌকা। সেখানে কোনো স্কুল নেই, সরকারি কোনো স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। নেই পানীয়জলের কোনো ব্যবস্থা। দুটি নলকূপের একটি অকেজো। ফলে মানুষ সারা বছর নদীর পানি পান করে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। গ্রামটিতে স্যানিটেশনের ব্যবস্থা না থাকায় গ্রামবাসী প্রাকৃতিক কাজ সারে নদীর পাড়ে অথবা খোলা আকাশের নিচে।
সম্প্রতি এই প্রতিবেদক কাশিপুর গেলে কথা হয় আবদুল হেকিম (৮০), জমশেদ মিয়া (৫৬), হাবিবুর রহমান (৫৮), আলিমুন নেসাসহ (৬২) আরও কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দার সঙ্গে। তাঁরা বলেন, বন্যা-নদীভাঙন থেকে গ্রাম রক্ষায় ১৯৭২ সালে নিজেরাই মাটি কেটে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বাঁধ তৈরি করেন। ১৯৭৪ সালের বন্যায় প্রথম বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। এরপর ১৯৭৮ ও ১৯৮৮ সালের বন্যার ভাঙনে বাঁধটি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বাঁধ নিশ্চিহ্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় গ্রামবাসীর জীবন-জীবিকা। বর্ষার সময় গ্রামের ফজলুর রহমানের পরিবারটি বাদে সব পরিবার হয়ে পড়ে গৃহহীন। তখন বাড়িঘর ফেলে তারা আশ্রয় নেয় পাশের ভাটিবরাটিয়া, ধিওরাইল ও ইন্দা গ্রামে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। কেউ কেউ চলে যায় বড় শহরে। শীতকালে আবার গ্রামে এসে ঘর বেঁধে বোরো জমি আবাদ করে।
গ্রামের আবদুল হেকিম (৮০) বলেন, ‘এ গ্রামে ম্যাট্রিক পাস দূরে থাক, অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে এমন লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ, এ গ্রামে কোনো সরকারি বা এনজিওচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ই নেই। গ্রামের কোনো লোক অসুস্থ হলে নিকলী সদর হাসপাতাল বা পার্শ্ববর্তী উপজেলা করিমগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। অনেক সময় রাস্তায় চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় রোগী মারা যায়।’
মজিবুর রহমান বলেন, গ্রামের কেউ মারা গেলে চার কিলোমিটার দূরের ভাটিবরাটিয়া বা সাত কিলোমিটার দূরে ধিওরাইল গিয়ে দাফন করতে হয়। না হলে নদীতে ভাসিয়ে দিতে হয়।
সিংপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘কাশিপুর গ্রামের এই দুরবস্থা কাটাতে হলে গ্রামটির চারপাশে বাঁধ নির্মাণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে গ্রামটিতে মানুষ ১২ মাস বসবাস করতে পারবে না।’
নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুব আলম বলেন, ‘এ মুহূর্তে গ্রামটি রক্ষায় বাঁধ নির্মাণের সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। তবে আমি বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপ করব।’