যে বিবেচনায় ঠিক হয় অভিযানের নাম

গুলশানের হলি আর্টিজান থেকে শুরু। সর্বশেষ কুমিল্লার কোটবাড়ী। ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে আজ শুক্রবার ৩১ এপ্রিল পর্যন্ত আট মাসে ১০টি জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নানা নামকরণ হয়েছে। কোনোটি অপারেশন থান্ডারবোল্ট, কোনোটি অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭ কোনোটি আবার অপারেশন স্টর্ম ২৬।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সাতটি জেলার বিভিন্ন এলাকায় এসব অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্য গুলশানের হলি আর্টিজান ও সিলেটের শিববাড়ি এলাকার আতিয়া মহলের অভিযানে সরাসরি অংশ নেয় সেনাবাহিনী। বাকি আটটি অভিযানের কোনোটি পুলিশ, কোনোটি র‍্যাব, কোনোটি সোয়াতের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে। তবে নেতৃত্বে যারাই থাকুক না কেন, প্রতিটি অভিযানের নামকরণ হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জঙ্গি অভিযানে অংশ নেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার গতিপ্রকৃতি, সময় ও ঘটনাস্থলের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে অভিযানের নাম দেওয়া হয়। এ ছাড়া নামকরণের জন্য শব্দ বাছাইয়ে অভিযানের অনেক কলাকৌশল জড়িত থাকে। এগুলো প্রকাশ না করাই ভালো বলে মনে করেন তাঁরা।

১০টি নামে অভিযান
২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ড’। ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গিরা হামলা চালালেও পুলিশের অভিযানের কোনো নাম দেওয়া হয়নি। এরপর ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়িতে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের জঙ্গি অভিযানের নামকরণ হয় ‘অপারেশন স্টর্ম-২৬’। এক মাস না যেতে ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় আরেকটি অভিযান চালায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। অভিযানটির নাম ছিল ‘অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭ ’। এ অভিযানে নিহত হয় নব্য জেএমবি নেতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী।

২ সেপ্টেম্বর রাতে মিরপুরের রূপনগরে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অভিযানে নিহত হয় নব্য জেএমবির জাহিদুল ইসলাম নামে অবসরপ্রাপ্ত এক মেজর। তবে এ অভিযানের নাম দেওয়া হয়নি।

রূপনগরের মতো আজিমপুরে ১০ সেপ্টেম্বর কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের আরেকটি অভিযানের নামকরণ হয়নি। এই অভিযানে নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা ও আশ্রয়দাতা তানভীর কাদেরী নিহত হয়। এবারও প্রায় এক মাস পর ৮ অক্টোবর জঙ্গি দমনে পৃথক তিনটি অভিযান চালায় পুলিশ ও র‍্যাব। গাজীপুর, আশুলিয়া ও টাঙ্গাইলের চার আস্তানায় এসব অভিযান চালানো হয়। গাজীপুরের পাতারটেকের একটি বাড়িতে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন স্পেইট এইট’। তবে আশুলিয়া ও টাঙ্গাইলে র‍্যাবের অভিযান দুটির নাম ছিল না। ২৪ ডিসেম্বর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে জঙ্গি নেতা তানভীর কাদেরীর ছেলেসহ দুজন নিহত হয়। ১২ ঘণ্টার এই অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন রিপল ২৪’।

এ অভিযানের পর চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দেশে কোনো জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়নি। এ বছরের প্রথম জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালানো হয় ১৭ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের একটি বাড়িতে। ‘অপারেশন অ্যাসল্ট ১৬’ নামে পুলিশ-সোয়াতের এ অভিযানে নিহত হয় চার জঙ্গি। সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় আতিয়া মহলে পাওয়া যায় আরেকটি জঙ্গি আস্তানা। ২৫ মার্চ থেকে শুরু এ অভিযান চলে ২৮ মার্চ পর্যন্ত। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে নামকরণ হয় ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। এতে নিহত হয় চারজন।

গতকাল মৌলভীবাজারের নাসিরপুরের একটি বাড়িতে পুলিশের অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন হিটব্যাক’। এ অভিযানে নারী-পুরুষ, শিশুসহ সাতটি লাশ পাওয়া যায়। সবশেষ আজ শুক্রবার মৌলভীবাজারের বড়হাট ও কুমিল্লায় চলছে পুলিশের আরও দুটি অভিযান। এর মধ্যে বড়হাটের বড়হাটের অভিযানের নাম হয়েছে ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ ও কোটবাড়ীর অভিযানের নাম ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’।

গত বছরের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে চলতি বছরের ২ মার্চ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩৯ জন জঙ্গি নিহত হয়, যাদের মধ্যে তামিম চৌধুরী, মেজর (অব) জাহিদুল ইসলাম, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান, সারোয়ার জাহানের মতো নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা রয়েছেন। এরপরে সীতাকুণ্ড ও সিলেটে আরও আট জঙ্গি নিহত হয়।

জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিকল্পিত অভিযানগুলোকে নাম দেওয়া হয়। অভিযানের নামকরণ হলে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কার্যক্রমে সহায়ক হয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জঙ্গি অভিযানে অংশ নেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জঙ্গিরা হঠাৎ করে আক্রমণ চালালে দ্রুত পাল্টা জবাব দেওয়া হয় বা প্রতিরোধ করতে অভিযান চালানো হয়ে থাকে। এসব অভিযানের নামকরণ হয় না। এ কারণেই শোলাকিয়ার ঘটনায় কোনো নামকরণ হয়নি। ঘটনার গতিপ্রকৃতি, সময় ও ঘটনাস্থলের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে অভিযানের নাম দেওয়া হয়। এ ছাড়া নামকরণের জন্য শব্দ বাছাইয়ে অভিযানের অনেক কলাকৌশল জড়িত থাকে। এগুলো প্রকাশ না করাই ভালো বলে মনে করেন তাঁরা।

বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন এক কর্মকর্তা আজ প্রথম আলোকে বলেন, নামকরণটা আসলে ‘কোড নেম’। তাৎক্ষণিকভাবে পরিচালিত অভিযানের ক্ষেত্রে এই কোড নেম ব্যবহৃত হয়। তবে যে অভিযানগুলো বড় এবং সুদূরপ্রসারী, সে সবের নামকরণের ক্ষেত্রে অনেক পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নেওয়া হয়। এই নামকরণ দেখে অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রর নির্বাহী পরিচালক ও জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষক নূর খান লিটন প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গি হামলার কোনো ঘটনাকে প্রতিরোধ করতে অথবা কোনো জঙ্গি আস্তানা উৎখাত বা দমন করতে প্রাক্‌-প্রস্তুতি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো অভিযান চালায়। এ ধরনের অভিযানগুলোরই নামকরণ হয়ে থাকে। ঘটনার আগে, ঘটনার সময় ও ঘটনার পরবর্তী বিষয়গুলো নামকরণ হওয়া অভিযানে লিপিবদ্ধ থাকে। এতে করে ভবিষ্যৎ কার্যক্রমে সহায়ক হয়।

দেশে আট মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১০টি অভিযানের প্রতিটির নামকরণ হয়েছে ইংরেজি শব্দে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে নূর খান লিটন বলেন, ‘অভিযানের কমান্ড যাঁরা করেন, তাঁদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে অভিযানের নামকরণ হয় বলে আমার ধারণা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো জঙ্গিরাও নিজেদের মতো করে প্রতিটি অভিযানের নামকরণ করে থাকতে পারে।’