যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটিতে বাইরের নারী সদস্য রাখতে অনীহা

যৌন হয়রানি
প্রতীকী ছবি

কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে প্রায় এক যুগ আগে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। এতে বলা হয়েছিল, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও এ–সংক্রান্ত ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির প্রধান ও বেশির ভাগ সদস্য হবেন নারী। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরের দুজন নারীকে কমিটিতে রাখতে হবে। তবে মালিকপক্ষ আপত্তি করায় কমিটিতে বাইরের দুজন নারী সদস্য রাখার বিষয়টি নতুন শ্রম বিধিমালার চূড়ান্ত খসড়ায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

শ্রম বিধিমালা, ২০২২–এর বিষয়ে ইতিমধ্যে আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়েছে। বিধিমালাটি নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিধিমালায় এখন আর সংশোধন আনার সুযোগ নেই।
চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে ন্যূনতম পাঁচ সদস্যের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির প্রধান হবেন একজন নারী; তবে ব্র্যাকেটে বলা হয়েছে ‘যদি নারী থাকে’। আর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে দুজন নারী প্রতিনিধি কমিটিতে রাখার বিষয়ে এতে কিছু বলা নেই।
তদন্তের দায়িত্ব কেবল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের হাতে থাকলে সঠিক তদন্ত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন শ্রম ও নারী অধিকার নেতারা। নারীনেত্রী কল্পনা আক্তার এটাকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়েছেন। বাইরের দুই নারী সদস্যের বিধান রেখে প্রজ্ঞাপন জারি না হলে প্রতিবাদ জানানোর কথা বলেছেন শ্রমিকনেতা বাবুল আক্তার।

কমিটিতে বাইরের প্রতিনিধি চায় না মালিকপক্ষ

শ্রম মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, খসড়া বিধিমালায় পাঁচ সদস্যের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে দুজন প্রতিনিধি রাখার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন খাতের মালিকপক্ষের চাপে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে। মালিকপক্ষ মনে করছে, কমিটিতে বাইরে থেকে কাউকে আনলে তাদের বিপদ বাড়বে।

এ বিষয়ে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ সদস্যের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটিতে বাইরে থেকে কাউকে আনলে অরাজকতা দেখা দেবে। স্বার্থান্বেষী মহল সুযোগ খুঁজবে। কমিটিতে স্বার্থান্বেষী মহলের এজেন্ট ঢুকে যেতে পারে। তারা কারখানার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। কোনো অবস্থাতেই কমিটিতে বাইরে থেকে প্রতিনিধি নেওয়ার বিধান করা যাবে না।

কমিটি গঠনের বিষয়ে মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, ‘পাঁচ সদস্যের কমিটিতে আমরা কারখানা থেকেই প্রতিনিধি দেব। একজন নারীকেই কমিটির প্রধান করা হবে। প্রয়োজনে কারখানা থেকেই পাঁচজন নারীকে দিয়ে কমিটি গঠন করে দেওয়া হবে। তবু বাইরে থেকে কাউকে আনা যাবে না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এই মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার আগেই বিধিমালার সবকিছু নির্ধারণ হয়ে গেছে। এখন শুধু প্রজ্ঞাপন জারির অপেক্ষা। এখন আর সংশোধনের সুযোগ নেই। তবে আইন সংশোধনের সময় যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে দুজন নারী প্রতিনিধি রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হতে পারে।’

যৌন হয়রানির সংজ্ঞায় কী বলা হয়েছে

২০১৫ সালে প্রণীত শ্রম বিধিমালায় কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির সংজ্ঞা নির্ধারিত ছিল না। তবে এবারের খসড়া বিধিমালায় কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি কেমন আচরণ হওয়া উচিত, তা স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মীদের শালীনতা ও সম্ভ্রমের প্রতি আঘাত হানে—এমন যেকোনো অসৌজন্যমূলক আচরণ যৌন হয়রানি হিসেবে বিবেচিত হবে।

যৌন হয়রানি বলতে অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আচরণ, যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক স্পর্শ, পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা যৌন হয়রানি হিসেবে ধরা হবে। এ ছাড়া নিপীড়নমূলক মন্তব্য করা, পর্নোগ্রাফি দেখানো, যৌন আবেদনমূলক অঙ্গভঙ্গি করাও যৌন হয়রানি বলে বিবেচিত হবে।

খসড়া বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি অশালীন ভঙ্গি করা, অশালীন ভাষা প্রয়োগ করে উত্ত্যক্ত করা, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষায় ঠাট্টা বা উপহাস করা, চিঠি-টেলিফোন-মুঠোফোনে বিরক্ত করা, ছবি তুলে কিংবা কার্টুন এঁকে ব্ল্যাকমেল করা অথবা চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে স্থির বা ভিডিও চিত্র ধারণ করাও যৌন হয়রানি বলে ধরা হবে।

এমনকি কর্মক্ষেত্রের চেয়ার, টেবিল, নোটিশ বোর্ড ও বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক কিছু লিখলে সেটা যৌন হয়রানি বলে বিবেচিত হবে। কর্মক্ষেত্রে কোনো নারীকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে চাপ প্রয়োগ করলে সেটাকেও যৌন হয়রানি বলা যাবে।

থাকতে হবে নীতিমালা, রাখতে হবে অভিযোগ বক্স

খসড়া বিধিমালায় উল্লেখ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নিজস্ব গাইডলাইন বা নীতিমালা তৈরি করবে। প্রতিষ্ঠানের সব সদস্যকে ওই নীতিমালা দিতে হবে। তাদের এটা মেনে চলতে হবে। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে একটি করে অভিযোগ বক্স রাখতে হবে। সেই বাক্সে জমা হওয়া অভিযোগ নিয়মিত রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে তা নিষ্পত্তি করতে হবে।

অবশ্য কারও বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেটার শাস্তি কী হবে, সে বিষয়ে খসড়া শ্রম বিধিমালায় কিছু বলা হয়নি। প্রচলিত আইনে এ অপরাধের শাস্তি হবে কি না, সেটাও খসড়ায় উল্লেখ নেই।

দীর্ঘ সময় পরে হলেও শ্রম বিধিমালায় যৌন হয়রানির বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন নারী অধিকারকর্মীরা। তবে তদন্তের দায়িত্ব কেবল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের হাতে থাকলে সঠিক তদন্ত নিয়ে সন্দিহান তাঁরা। তাঁদের মতে, প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন ও প্রভাবশালী কারও বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে কমিটির সদস্যরা চাপমুক্ত থেকে তদন্ত করতে পারবেন না।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, কেবল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের দিয়ে অভিযোগের তদন্ত করাটা একটা প্রহসন। বাইরের সদস্যরা থাকলে তদন্ত কমিটির একটি স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকত। তদন্তের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নারী প্রধানকে চাপ প্রয়োগ করে বক্তব্য পাল্টে দিতে পারে কর্তৃপক্ষ।

শ্রমিকনেতা বাবুল আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রম বিধিমালার খসড়া নিয়ে মতামত নিতে আমাদের ডাকা হয়েছিল। সেখানে সব পক্ষ থেকেই মতামত এসেছিল। আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পাঁচ সদস্যের কমিটিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে দুজন প্রতিনিধি রাখতে হবে। এরপর কী হয়েছে, তা জানি না।’

বাবুল আক্তার আরও বলেন, ‘প্রজ্ঞাপন জারির পর যদি দেখি বাইরে থেকে দুজন সদস্য রাখার বিধান নেই, তাহলে আমরা প্রতিবাদ করব। বাইরের প্রতিনিধি না থাকলে যৌন হয়রানি বন্ধ করা সহজ হবে না।’