রক্তের বিরল গ্রুপ ‘বোম্বের’ তথ্যভান্ডার নেই দেশে

দেশে বোম্বে গ্রুপের রক্তের মানুষ ৪০ জনের কম
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর সানজিদা আক্তার যখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন তাঁর রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। রক্ত দেওয়ার আগে পরীক্ষায় জানা যায়, তাঁর রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজিটিভ। একটি ক্লিনিকে ‘ও’ পজিটিভ রক্ত দেওয়া শুরু করতেই সানজিদার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়। এভাবে তিনবার রক্ত দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর বেসরকারি আরেকটি হাসপাতালে। ‘ও’ পজিটিভ রক্তদাতাদের সঙ্গে সানজিদার রক্তের ক্রস ম্যাচিং করে জানা যায়, কারও রক্তের সঙ্গেই তাঁর রক্তের গ্রুপটি মিলছে না। এরপর সানজিদার রক্তের নমুনা পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পরীক্ষায় জানা যায়, তাঁর রক্তের গ্রুপ ‘বোম্বে’।

রাজধানীর একটি হাসপাতালে ১৭ মার্চ সানজিদাকে রক্ত দেওয়া হয়
ছবি: সংগৃহীত

‘বোম্বে’ বিরলতম রক্তের একটি গ্রুপ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে ‘বোম্বে’ গ্রুপের রক্ত শনাক্ত করা হয়। বিভাগটির দেওয়া তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত দেশে সানজিদার মতো ‘বোম্বে’ গ্রুপের রক্ত আছে ৪০ জনের শরীরে। রোগীকে রক্ত দেওয়ার সময় জটিলতা দেখা দিলে তখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ট্রান্সফিউশন বিভাগে রক্তের নমুনা পাঠানো হয়। তাই এই রক্তের দাতা কতজন, তা জানার কোনো উপায় নেই। রোগী হিসেবে যাঁরা এই বিভাগে যান, তাঁদের তথ্য সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে।

চিকিৎসক ও রক্ত নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা বলছেন, ভারতে প্রতি ১০ হাজারে একজনের মধ্যে ‘বোম্বে’ গ্রুপের রক্ত পাওয়া যায়। সারা বিশ্বে ‘বোম্বে’ গ্রুপের রক্ত আছে, এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র ২৮ হাজার। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো পরিসংখ্যানই নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় জানা যায়, সানজিদার রক্তের গ্রুপ ‘বোম্বে’
ছবি: সংগৃহীত

১৯৫২ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটে ‘বোম্বে’ গ্রুপের রক্ত নিয়ে ভারতীয় তিন চিকিৎসক উয়াই এম ভেন্ডে, সি কে দেশপান্ডে ও এইচ এম ভাটিয়া একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে বলা হয়েছে, ভারতের মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে আহত একজন রেলশ্রমিকের শরীরে প্রথম এই রক্তের গ্রুপটি শনাক্ত হয়। মুম্বাইতে (মুম্বাইয়ের আগের নাম বোম্বে) শনাক্ত হওয়ায় চিকিৎসক ভেন্ডে এই গ্রুপের রক্তের নাম দেন ‘বোম্বে’। এই গ্রুপের রক্তকে ইংরেজি ছোট হাতের অক্ষর এইচএইচ অথবা বড় হাতের ও এবং ছোট হাতের এইচ অক্ষরের (Oh গ্রুপ) গ্রুপের রক্তও বলা হয়।

‘বোম্বে’ গ্রুপের রক্ত নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক আয়েশা খাতুন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের শতকরা ৩৩ দশমিক ৯৭ ভাগ মানুষের রক্ত ‘ও’ গ্রুপের। ‘ও’ গ্রুপেরই ভিন্ন একটি রূপ ‘বোম্বে’ গ্রুপ। এখন রক্তের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে। রক্তের সঠিক গ্রুপ নির্ণয়ের সুযোগ বাড়ায় ‘বোম্বে’ রক্তের গ্রুপ নিয়ে কথা হচ্ছে। যাদের রক্তের গ্রুপ ‘ও’ তাদের সঠিক গ্রুপিং হলে ‘বোম্বে’ ব্লাড গ্রুপের সংখ্যা আরও বাড়বে।
অধ্যাপক আয়েশা খাতুন আরও বলেন, কারও রক্তের গ্রুপ ‘বোম্বে’ হলে সবার আগে তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে ‘বোম্বে’ গ্রুপের সন্ধান করতে হবে। মা ও বাবা হিটারোজাইগাস Oh জিনের ধারক-বাহক হলে তাঁদের ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের রক্তও বোম্বে গ্রুপের হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, রক্তের গ্রুপ কী হবে, সে বিষয়টি কারও হাতে নেই। এটা জিনগত বিষয়। অন্য সাধারণ গ্রুপের মতো বোম্বেও রক্তের একটি গ্রুপ। তবে আমাদের দেশে যাদের রক্তের গ্রুপ বোম্বে, তারা সামাজিক চাপে ও হেনস্তার কারণে গণমাধ্যমের সামনে আসতে ভয় পান।

বিরল গ্রুপ হওয়ার কারণে সানজিদার রক্ত সংগ্রহের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। রক্তস্বল্পতার কারণে সানজিদার শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তাঁকে রক্ত দেওয়ার আর কোনো বিকল্প ছিল না। এ ছাড়া তাঁকে যিনি রক্ত দেবেন তাঁকেও ‘বোম্বে’ গ্রুপের হতে হবে। অবশেষে ১৭ মার্চ সানজিদার পরিবার বোম্বে গ্রুপের এক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে। তবে চিকিৎসকেরা বলেন, সানজিদাকে আরও তিন ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। এ ছাড়া সন্তান জন্মের সময়ও তাঁকে রক্ত দেওয়ার জন্য দাতা প্রস্তুত রাখতে হবে।
সানজিদার বাবা মো. সাবের ১৭ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, সানজিদাকে একজন রক্ত দিয়েছেন। যিনি রক্ত সংগ্রহ করে দিলেন এবং যিনি রক্তদান করলেন, তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। বলেন, রক্তদাতার নাম, ঠিকানা কিছুই জানি না। রক্ত দিয়ে টাকাপয়সাও নেননি তিনি।

বোম্বে বিরলতম রক্তের একটি গ্রুপ
ছবি: সংগৃহীত

সানজিদার স্বামী মো. সাদ্দাম বললেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় রক্তের খোঁজ করেছি। অবশেষে একজনের কাছে মালয়েশিয়ায় কর্মরত মো. নাঈম মজুমদার নামের একজনের খোঁজ পাই। মালয়েশিয়া থেকে ফেসবুকের মাধ্যমে ‘রক্তকমল ফাউন্ডেশন’ এবং ‘রক্তবন্ধু ডটকমের’ সহসভাপতি ও অ্যাডমিন হিসেবে ‘বোম্বে’ গ্রুপের রক্তদাতার ব্যবস্থা করেন তিনি। তবে রক্তদাতাদের অনুরোধে তাঁদের পরিচয় জানাননি।’

হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় নাঈম মজুমদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক যুগ ধরে রক্ত নিয়ে কাজ করলেও দেশে ‘বোম্বে’ রক্ত নিয়ে কাজ করছেন মাত্র দেড় বছর। এখন পর্যন্ত ‘বোম্বে’ রক্তের দাতা পেয়েছেন মাত্র চারজন। এই চারজনও আবার সব সময় রক্ত দিতে প্রস্তুত থাকেন না। একবার রক্ত দিলে ওই দাতাকে আবার রক্ত দেওয়ার জন্য চার মাস অপেক্ষা করতে হয়। তাই এই রক্তের দাতা সংগ্রহ করা প্রায় যুদ্ধের শামিল। আর মালয়েশিয়াতে নিজের কাজের পাশাপাশি এই কাজ করতে হয় বলে তা আরও কঠিন হয়ে যায়।

২০১৬ সালের জুনে ‘বোম্বে’ রক্তের বিষয়টি গণমাধ্যমের আলোচনায় আসে। রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে মোহাম্মদ কামরুজ্জামান নামের এক ব্যক্তির অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচারের সময় রক্তের প্রয়োজন পড়ে। তখন জানা যায়, তাঁর রক্তের গ্রুপ ‘বোম্বে’। রক্তের জন্য কামরুজ্জামানের অস্ত্রোপচার এক মাস থেমে ছিল। ওই বছরের ২১ মে সড়ক দুর্ঘটনায় কামরুজ্জামানের বাঁ হাত, বাঁ পা ও কোমর ভেঙে যায়। তখন তাঁর জন্য ‘বোম্বে’ গ্রুপের রক্ত দেশে পাওয়া যায়নি। কামরুজ্জামানের এক সহকর্মী মুম্বাইয়ের ‘থিঙ্ক ফাউন্ডেশন’ থেকে রক্ত জোগাড় করে দেন।

দেশে যাদের রক্তের গ্রুপ ‘বোম্বে’ তাদের পরিবার ও রক্ত নিয়ে কাজ করা অল্প কিছু মানুষ ‘বোম্বে’ গ্রুপ সম্পর্কে জানে। অন্তঃসত্ত্বা সানজিদার চিকিৎসক ফারহানা দেওয়ান বলেন, ১৯৮২ সাল থেকে তিনি চিকিৎসা পেশায় জড়িত। এর আগে এই গ্রুপের রক্তের আর কোনো রোগীর চিকিৎসা করেননি তিনি।

সানজিদার মতো আরেক ভুক্তভোগী বরিশালের রাজমিস্ত্রি আবু বক্কর সিদ্দিকের তিন বছর বয়সী ছেলে। ছোট ছেলেকে নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন সিদ্দিক। ছেলের রক্তস্বল্পতা দেখা দেওয়ায় বরিশালে ‘ও’ পজিটিভ রক্ত দিতে নিয়ে যান। রক্ত দেওয়া শুরুর পরই ছেলের খিঁচুনি শুরু হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর প্রথম ‘বোম্বে’ গ্রুপের নাম জানতে পারেন তিনি। সিদ্দিক তাঁর এক বোনের সহায়তায় ফেসবুকে ‘বোম্বে’ রক্ত চেয়ে পোস্ট দিয়ে রক্তদাতা পেয়েছিলেন। এই বাবা জানান, তাঁর রক্তের গ্রুপ ‘এবি’ পজিটিভ আর তাঁর স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজিটিভ। ছেলের ‘ও’ পজিটিভ বলেই তাঁরা জানতেন। আবার কখনো ছেলের রক্ত লাগলে তখন তিনি কী করবেন, তা জানেন না।

ফেসবুক গ্রুপ ‘রক্তদানের অপেক্ষায় বাংলাদেশ’–এর সদস্যসংখ্যা ৩ লাখ ১৫ হাজার। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সুব্রত দেব জানান, তিনি ৯ বছরের বেশি সময় ধরে রক্তদান নিয়ে কাজ করছেন। এত সদস্যের মধ্যে কারও ‘বোম্বে’ গ্রুপের রক্ত নেই। তবে দুজন ‘বোম্বে’ গ্রুপের তথ্য সংরক্ষণ করে রেখেছেন। সুব্রত বললেন, ভারতে ‘বোম্বে’ রক্ত নিয়ে সংঘবদ্ধ কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশে সেভাবে নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি।

বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধনের প্রেসিডেন্ট সেলিম রেজা জানান, তিনি এখন পর্যন্ত ‘বোম্বে’ নামে রক্তের গ্রুপের কথা শোনেননি।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশরাফুল হক বলেন, প্রয়োজন না হলে রক্তের বিষয়ে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। রমনা পার্ক, উড়ালসড়কের নিচেও রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হচ্ছে। মৌখিকভাবে যে যার রক্তের গ্রুপ বললেই, তা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ গুরুত্বপূর্ণ সনদও দেওয়া হচ্ছে। ‘বোম্বে’ বা অন্য বিরল রক্তের গ্রুপ যাদের, তারা নিজেদের সঙ্গে কোনো কার্ড রাখছে না। এই ব্যক্তিরা সড়ক দুর্ঘটনাসহ যেকোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে এবং রক্ত দিতে হলে তখন জটিলতার সৃষ্টি হবে। ‘বোম্বে’সহ বিরল রক্তের গ্রুপের ব্যক্তিদের জাতীয় তথ্যভান্ডার থাকা দরকার বলে অভিমত তাঁর।

গাজীপুরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, চার মাস আগে তাঁর বাবা (৭০) ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। যখন তাঁর বাবাকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখনই তিনি জানতে পারেন, তাঁর বাবার রক্তের গ্রুপ ‘বোম্বে’। সে সময় নাঈম মজুমদার রক্ত যোগাড় করে দেন। অবশ্য পরে তাঁর বাবা বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় মারা যান।

তরিকুল ইসলাম বলেন, তাঁর বাবার রক্ত পরীক্ষার পর তিনি এবং তাঁর যমজ দুই বোনও রক্ত পরীক্ষা করান। তবে তাঁদের কারও রক্তের গ্রুপ ‘বোম্বে’ নয়। বাবার জন্য রক্ত সংগ্রহে যে ভোগান্তি গেছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তরিকুল ইসলামও ‘বোম্বে’ রক্ত নিয়ে সচেতনতাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন বলে ঠিক করেছেন।