রক্ত দানে সবেচেয়ে বেশি তৃপ্ত হয়েছি

প্রথম রক্ত দানের কথা আজো মনের স্মৃতিপটে ভেসে উঠে।

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। মাষ্টার দা সূর্য সেন হলে বড় ভাইয়ার সঙ্গে এক কক্ষে থাকথাম। একদিন ক্লাস শেষে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এমন সময় স্বেচ্ছায় রক্ত দানের সংগঠন 'বাঁধন' এর হল শাখার সভাপতি পারভেজ ভাই আসলেন। তিনি গল্পে গল্পে আমার রক্তের গ্রুপ জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ভাই- আমার রক্তের গ্রুপ তো জানি না। পারভেজ ভাই বললেন, চলো তোমার রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে দেই। আমাকে নিয়ে হলের বাঁধনের অফিসে গেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে গ্রুপ পরীক্ষা করে বললেন, আরে যা ভেবে ছিলাম তাই হলো! তোমার রক্তের গ্রুপ 'এ পজেটিভ'। পারভেজ ভাই মহাখুশি, আমিও তার খুশি দেখে খুশি হলাম। ঘটনার পরের অংশটা একটু অন্যরকম; পারভেজ ভাই বললেন, 'যশোর থেকে এক মাদরাসা শিক্ষক তাঁর ছেলেকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য পিজি (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে এসেছেন। তার ছেলের বয়স তোমার মতোই। তার ছেলের জরুরীভাবে আগামীকাল এ পজেটিভ রক্ত দিতে হবে। এ পজেটিভ রক্ত অনেক সহজলভ্য হলেও আমি চেষ্টা করে পাচ্ছি না। উনি অনেক কয়বার এসেছেন। আমার রুমের সামনে এখন দাড়িয়ে আছে। আমার কেন যেন মনে হলো তোমার কথা। কাউকে না পেয়ে তোমার রক্ত পরীক্ষা করে দেখলাম, আমার ধারণা ঠিক হলো, এখন তুমি যদি চাও, তাহলে সেই অসহায় মাদরাসা শিক্ষকের ছেলেকে রক্ত দিতে পার।'

পারভেজ ভাইয়ের কথায় মনটা নরম হয়ে গেল। পারভেজ ভাইয়ের সঙ্গে উনার রুমের সামনে দেখলাম, একজন বয়স্ক লোক দাড়িয়ে আছেন। বুঝলাম উনিই সেই মাদরাসা শিক্ষক। চেহারা মলিন। আমার মনটা আবার একটু বেশিই নাড়া দিলো। হঠাৎ পারভেজ ভাই একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি বললেন, তোমার বড় ভাইয়ের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। উনি যদি কিছু মনে করেন। একটু পর বড় ভাই ক্যাম্পাস থেকে আসলেন। পারভেজ ভাই নিজে ভাইকে আমার রক্ত দানের ইচ্ছার কথা ও ঐ শিক্ষকের কথা জানালেন। বড় ভাই বললেন, ও মাত্র ক্লাস শুরু করেছে, হলের খাবার ভালো নয়। মা শুনলে রাগ করতে পারে। এ পজেটিভ রক্ত তো অনেক সহজলভ্য। তুমি বরং অন্য কাউকেও একটু ম্যানেজ করে দাও। পারভেজ ভাই, আর কিছু বললেন না। তিনি বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেলেন, তিনি যতবার এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন, ততবারই দেখেছেন বড় ভাই ভাই-বোন, বাবা-মা কখনোই ছোট ভাই, সন্তানদের রক্ত দান করতে উৎসাহিত করেন না। তাঁরা মনে করেন, রক্ত দিলে রক্তদাতা দুর্বল হয়ে যায়। এ ছাড়া অন্য শারিরীক সমস্যা দেখা দেয়। এটা কমন একটা ধারণা। যা হোক, তোমাকে ধন্যবাদ, তুমিতো দিতে চেয়েছিলো। আমি বেশ অপ্রস্তুত ও বিব্রত হলাম, মনে মনে বেশ কষ্ট লাগল। রাতে ঘুমানোর আগে বড় ভাইয়ের সঙ্গে আবার এ বিষয় নিয়ে কথা বললাম। ইচ্ছার কথা তাকে বললাম। কোনো সমস্যা হবে না মর্মে আশ্বস্ত করলাম। অবশেষে বললেন, যদি এ পজেটিভ রক্ত না পাওয়া যায় তবে দিস। মনে মনে খুব স্বস্তি পেলাম। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম, আগামীকোল যেন রক্ত দিতে পারি।

পরের দিন সকালবেলা ক্লাসে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছি, দেখি রুমের সামনে ওই মাদরাসা শিক্ষক অসহায়ভাবে দাড়িয়ে আছেন। বললাম, আপনি এতক্ষণ ডাকেননি কেন? উনি বললেন, আমি একটু দ্বিধায় পড়েছি, তাই তোমায় ডাকছি না। বুঝলাম, উনি আমার বড় ভাইয়ের জন্য ডাকতে দ্বিধায় ছিলেন। ভাই আগেই ক্যাম্পাসে চলে গিয়েছিল। শিক্ষককে বললাম, ভাই রাতেই রক্ত দানে সম্মতি দিয়েছেন।

খুশি হয়ে শিক্ষকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) গেলাম। সকল প্রক্রিয়া শেষে রক্ত দানের জন্য বিছানায় শায়িত হলাম। খুব গর্ব হচ্ছিল নিজেকে নিয়েই। এর মতো এতো ভালো লাগা জীবনে আর কখনো লাগেনি। খুব খুব খুবই প্রশান্তি পেয়েছিলাম সেদিন, সেই বাবার মুখ দেখে। তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে দোয়া করেছিলেন। তারপর তার সেই সন্তানকে দেখতে গেলাম। হ্যাঁ, সত্যিই সে ছিলো আমার বয়সই এবং আমার মতোই একহারা ধরনের স্বাস্থ্য। উনাদের সঙ্গে স্বাভাবিক বিদায় নিয়ে হলে ফিরে আসলাম, এক অন্যরকম ভালোলাগা আর প্রশান্তি নিয়ে।

আমি এরপর আর কখনোই পিছনে ফিরে তাকাইনি। একের পর এক রক্ত দিয়ে গেছি। সেই ভালোলাগা ও প্রশান্তির জন্য বারবার ফিরে যাই রক্ত দানের সেই বিছানায়। রক্ত দানে প্রধানত মানসিক প্রশান্তিই মূখ্য ছিলো। আর রক্তদানের পরে সেই হাসি দেখে অনেক ভালো লাগত। ঢাকা শহরের পরিচিত সরকারি-বেসরকারি প্রায় সকল হাসপাতালে একাধিকবার রক্ত দানের অভিজ্ঞতা আছে। ঢাকা মেডিক্যাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) অন্তত ২০বার রক্ত দিয়েছি। প্রতি বারই এক অসম্ভব ভালো লাগা নিয়ে বের হয়েছি। কাকে রক্ত দিচ্ছি তা কখনই বিবেচ্য হয়নি। অনেক সময় অনেক গ্রহীতার নিকটজনের আচরণ স্বাভাবিক না হলেও তা নিয়ে কখনোই মনো:কষ্টে ভুগিনি। এমন আনন্দ লাভের সুযোগ দানের জন্য তাদের প্রতি কৃতঙ্গতা জ্ঞাপন করেছি। শতকরা ৯৯ ভাগ রক্ত গ্রহীতার নিকটজনের এমন অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখেছি, যা অনেক বেশি প্রেরণাদায়ক।

আমি শুধু রক্ত দাতাই নই বরং কিছুদিনের মধ্যেই একজন রক্ত সংগ্রহকারী হিসেবে বেশ ভালোভাবে কাজ শুরু করলাম। বাঁধন-এর হয়ে অনেকজনের জন্য রক্ত সংগ্রহ করে আরো বেশি তৃপ্তি বোধ করতাম। এক সময় নিজের রক্ত দানের কার্ড-এ হিসাব রাখতাম, কোন কোন হাসপাতালে কতবার রক্ত দিয়েছি। পঞ্চাশ পেরোনোর পর আর হিসাব রাখতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট স্যার রক্তদানের জন্য ক্রেস্ট ও সংবর্ধনা দিয়েছেন। তারপর চাকরি সূত্রে যেখানেই যখন থেকেছি সবখানেই নিজে রক্ত দান করেছি আবার সংগ্রহকারী হিসেবেও কাজ করেছি। অনেক ধরনের ব্যস্ততা থাকলে রক্ত দানের সঙ্গে সবসময় জড়িত থেকেছি।

শিক্ষকতায় আসার পরে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও ডাটাবেজ সংরক্ষণের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের রক্ত দানে উৎসাহিত করেছি। নিজে রক্ত দান করে অন্যদের রক্ত দানে উৎসাহিত করেছি। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোভার স্কাউট-এর জেলা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে রক্ত দানের জন্য আরো বেশি কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের ফলে এ থেকে এখন অনেক সাধারণ মানুষ উপকার লাভ করছেন। রক্ত দান করলে মানব শরীরের যে কোনো সমস্যা হয় না বরং আরো ভালো তা বুঝালে সবাই অনেক উৎসাহিত হয়। এর ফলে শরীরে কোনো নিরব ব্যাধী বাসা বাঁধলে জানা যায়, সেটা অনেক বড় একটা মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে। এরকম অনেক উপকারিতা যদি তরুণদের মাঝে ভালোভাবে উপস্থাপন করা যায় তাহলে জীবন্ত ব্লাড ব্যাংক হিসেবে হাজারো স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুস করে রাখা সম্ভব হবে। যারা যেকোনো প্রয়োজনে রক্ত দান করতে পারবে আর এর সুফল পাবে সব মানুষ।

আমি স্বপ্ন দেখি আর কোনো বাবা যেন রক্তের জন্য দ্বারে দ্বারে না ঘুরে বরং রক্ত প্রয়োজন ১ ব্যাগ কিন্তু রক্ত দানের জন্য প্রস্তুত আছে ৫ জন। তবেই আমরা তৃপ্ত হতে পারব।
*প্রভাষক (দর্শন), বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাউশি। শিক্ষা প্রেষণে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্ট্যাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল ফেলো। [email protected]