রাবেয়ার পা তো গেলই, সংসারও ধুঁকছে

এক পায়ে রড বসানো, অন্য পা নেই। তাই চলাফেরার জন্য হুইল চেয়ারই একমাত্র ভরসা রাবেয়ার। ছবি: আব্দুল্লাহিল ওয়ারিশ
এক পায়ে রড বসানো, অন্য পা নেই। তাই চলাফেরার জন্য হুইল চেয়ারই একমাত্র ভরসা রাবেয়ার। ছবি: আব্দুল্লাহিল ওয়ারিশ

‘একা দাঁড়াইতেও পারি না। এক মিনিট দাঁড়াইলেই ব্যথা করে। তাই হুইল চেয়ারে চলি। কোনো কাম করবার পারি না। টাকার অভাবে ওষুধ খাইতে পারছি না। যে ট্যাকা পাইছিলাম, তা দিয়ে একটা অটো কিনছি। পোলার বাপ হেইডা চালায়। যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাই।’ 

গত বুধবার সাভারের বক্তারপুরের ভাড়া বাসায় এভাবে নিজের দুরবস্থার কথা জানান রাবেয়া বেগম। রানা প্লাজা ধসে পড়ার আগে ভবনটির সপ্তম তলার নিউওয়েভ স্টাইল লিমিটেডের হেলপার হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। 

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় রাবেয়ার বুকের চারটি হাড় ভেঙে যায়। পা দুটো ভাঙলেও তা ওই সময় বিচ্ছিন্ন হয়নি। ঘটনার আট মাসের মাথায় আর রাখা যায়নি। বাঁ হাঁটুর নিচ থেকে পা কেটে ফেলা হয়। ডান পায়ের মধ্যে রড বসিয়ে দেওয়া হয়। মাস খানেক আগ পর্যন্ত সাভারের সিআরপিতেই তাঁর চিকিৎসা চলে। মাত্র মাস খানেক হলো তিনি বাসায় এসেছেন। 

ঘটনার পর যাঁদের হাত পা কাটা যায়, প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে তাঁরা ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে অনুদান পেয়েছেন। রাবেয়ার কপাল খারাপ। আট মাস পর পা হারালেও প্রধানমন্ত্রীর অনুদান মেলেনি। যেটুকু ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, তা দিয়ে আর কত দিন চলবে? 

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের পর মারাত্মক আহত রাবেয়াকে উদ্ধার করে উদ্ধার-কর্মীরা সাভারের স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করেন। পর দিন তাঁকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। তাঁর বুকের চিকিৎসার জন্য ২৭ এপ্রিল নেওয়া হয় মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। সেখানে আট দিন চিকিৎসা চলার পর আবার পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর অভিযোগ, অনেকটা জোর করে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে তাঁকে ছুটি দেওয়া হয়। এর পর প্রায় তিন মাস সাভারের বাসায় থাকেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে ১১ ডিসেম্বর সাভারের সিআরপিতে ভর্তি হন। তারপর তাঁর এক পা কাটা হয়, আরেক পায়ের মধ্যে রড বসানো হয়। গত মাস পর্যন্ত হাসপাতালেই দিন কাটে।

চলাফেরার জন্য হুইল চেয়ারই একমাত্র ভরসা রাবেয়ার। ছবি: আব্দুল্লাহিল ওয়ারিশ
চলাফেরার জন্য হুইল চেয়ারই একমাত্র ভরসা রাবেয়ার। ছবি: আব্দুল্লাহিল ওয়ারিশ



রাবেয়ার ভাষ্য, দুর্ঘটনার পর রানা প্লাজা ডোনারস ট্রাস্ট ফান্ড নামের আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে তিনি তিন লাখ ৫৭ হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রথমে পান ৫০ হাজার টাকা, এরপর এক লাখ ৫৪ হাজার টাকা ও গত ৮ এপ্রিল পেয়েছেন এক লাখ ৫৩ হাজার টাকা। এর বাইরে নিউওয়েভ স্টাইল লিমিটেড থেকে এক মাসের বেতন ছয় হাজার টাকা পেয়েছেন। সরকারি খরচে চিকিৎসা পেয়েছেন।

রাবেয়া জানান, প্রথম দিকে যে দুই লাখ টাকা পেয়েছিলেন, তা গত দুই বছরে সংসারে খরচ হয়ে গেছে। এ মাসে পাওয়া এক লাখ ৫৩ হাজার টাকা দিয়ে একটি অটোবাইক কিনেছেন। এ অটোবাইকেই কোনো রকমে সংসার চলছে। তিনি বলেন, ‘আমার মতো যারা পা হারাইছে, তারা তো প্রধানমন্ত্রীর অনুদান পাইছে। তাদের মতো আমিও পাইলে অন্তত নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম। পুলাপাইন নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারতাম।’

অজানা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাবেয়া প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি কামনা করেন। তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী যদি একটু সদয় হন, হয়তো বাকি দিনগুলো কোনো মতে পার করা যাবে।
স্বামী-স্ত্রী মিলে ভালোই চলছিল রাবেয়ার সংসার। দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন আগেই। ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে চলছিল তাঁদের সংসার। কিন্তু রানা প্লাজা ধসে তাঁর সব স্বপ্নই ধূসর হয়ে যায়। এখন তিনি নিজে কীভাবে বাঁচবেন, কীভাবে সংসার চালাবেন, সন্তানদের কী হবে-এ চিন্তাই তাঁকে সারাক্ষণ বিষণ্ন রাখে। তাঁর ভাষায়, ‘বাড়িতে এক কড়া জায়গা নাই, ঘরদোরও নেই। এভাবে কত দিন থাকব। কীভাবে চলব। পুলাপাইনগো কি হবে। সব সময় এই চিন্তায় থাকি।’

রাবেয়া বেগমের বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার পূর্বচরকৃষ্ণপুর গ্রামে। এখন থাকেন সাভার পৌর শহরের বক্তারপুরে এক কক্ষের ভাড়া বাসায় (সাবলেট। প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয় তাঁদের। রয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল। দুই সন্তানের পড়াশোনা। প্রতিমাসে প্রায় দুই হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে খরচ ১০ হাজার টাকার বেশি।

রাবেয়ার ছোট দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মো. মাহফুজুর রহমান স্থানীয় একটি স্কুলে তৃতীয় শেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে পড়ে প্রথম শ্রেণিতে। নিজের চলাফেরা ও রান্নাবান্নার জন্য বড় মেয়েকে কাছে রেখেছেন। সে-ই সব কাজ করে। এক কক্ষের ওই বাসায় আছে কেবল একটি খাট ও একটি টেলিভিশন। এর বাইরে আছে প্লাস্টিকের একটি চেয়ার। একটি হুইল চেয়ার।

রাবেয়ার প্রধানমন্ত্রীর অনুদান না পাওয়া প্রসঙ্গে বিজিএমইএর অতিরিক্ত সচিব জগলুল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিরা নিয়ম অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। রাবেয়াও তা পেয়েছেন। ঘটনার পর ওই সময় তাঁর পা ছিল। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অনুদান পাননি।