রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘে ভোটের বিষয় স্পষ্ট করলেন প্রধানমন্ত্রী

আজ বুধবার জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরপর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ছবি: পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘে আনা প্রথম প্রস্তাবে মানবাধিকার বা যুদ্ধ বন্ধের কথা ছিল না। প্রস্তাবটি ছিল শুধু একটি দেশের বিরুদ্ধে, এ কারণে বাংলাদেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। পরবর্তী প্রস্তাবে মানবাধিকারের বিষয় থাকায় বাংলাদেশ ভোট দিয়েছে।

আজ বুধবার জাতীয় সংসদে এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেছেন, যুদ্ধ একা একা হয় না। কেউ না কেউ উসকানি দিচ্ছে। যুদ্ধটা কারা বাধিয়েছে, সেটাও দেখতে হবে।

রাশিয়াকে বন্ধুপ্রতিম দেশ উল্লেখ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশটির ভূমিকা তুলে ধরে সংসদ নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন পাকিস্তানের পক্ষে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল, তখন রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। সরকারি দলের সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে এ বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানান।

আরও পড়ুন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুঃসময়ে যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, আমরা নিশ্চয়ই তাদের পাশে থাকব। কিন্তু তারা যদি কোনো অন্যায় করে, সেটা আমরা মানব না। আর আমরা যুদ্ধ চাই না। কিন্তু যুদ্ধটা বাধাল কারা? উসকানিটা দিল কারা, সেটাও আপনাদের দেখতে হবে। যেহেতু একটি দেশের বিরুদ্ধে, এ জন্য সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা ভোট দেব না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যুদ্ধ তো একা একা বাধে না। উসকানি তো কেউ না কেউ দিচ্ছে। দিয়ে টিয়ে তো বাধাল যুদ্ধটা। তাহলে একটা দেশকে কনডেমড (নিন্দা) করা হবে কেন? সে জন্য আমরা ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলাম।’

এর আগে সম্পূরক প্রশ্নে জাতিসংঘে আনা প্রস্তাবে প্রথমবার ভোট না দেওয়া এবং দ্বিতীয় প্রস্তাবে ভোট দেওয়ার বিষয়ে জানতে চান বিরোধী দলের সাংসদ মুজিবুল হক।
দ্বিতীয় প্রস্তাবের ভোট দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, দ্বিতীয় প্রস্তাবে যুদ্ধের ফলে শিশুসহ ইউক্রেনের মানুষের কষ্ট, মানবাধিকারের বিষয়টি ছিল। এ কারণে বাংলাদেশ ভোট দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার মনে হয়, এটা একেবারে স্পষ্ট। এটা নিয়ে আর কারও কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়।’

দেশের লোক র‍্যাবের বদনাম করেছে

সম্পূরক প্রশ্নে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক র‌্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে সেখানকার বাংলাদেশি দূতাবাস কেন তা জানতে পারেনি, সেটাও জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নাইন-ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে সন্ত্রাস দমনে তখনকার বিএনপি সরকার র‌্যাব সৃষ্টি করেছিল। তারা র‌্যাবকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর র‌্যাব জঙ্গি, সন্ত্রাস দমন, হত্যার তদন্তসহ মানবিক কাজই করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, তারা মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করছে।

আরও পড়ুন

র‍্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, দেশে কিছু মানুষ আছে, যারা অস্বাভাবিক সরকার থাকলে ভালো থাকে। তাদের গুরুত্ব থাকে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান থাকলে তারা ভালো থাকে না। এ জন্য তারা সব সময় সরকারের বিরুদ্ধে লেগে থাকে। তারা সব সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। র‍্যাব সম্পর্কে অভিযোগ, অপপ্রচারও তারাই চালিয়েছে। কংগ্রেসম্যান, সিনেটরদের কাছে তথ্য পাঠানো, চিঠি দেওয়াসহ নানাভাবে তারা এ অপপ্রচার করে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাস সব সময় সক্রিয় ছিল। কিন্তু যখন এ বিষয়ে আলোচনা করেছে, তখন তারা দূতাবাসের কাউকে ঢুকতে দেয়নি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, র‍্যাবের কোনো সদস্য যখনই অন্যায় করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। একজন মন্ত্রীর জামাতা একটি অপরাধ করেছিলেন, তাঁকেও ক্ষমা করা হয়নি। বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।

কারও নাম উল্লেখ না করে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের কিছু কিছু লোক আছে তারা একটু বুদ্ধিজীবী, ইনটেলেকচুয়াল, অমুক, সমুক নানা ধরনের সংগঠন তারা করে। এই সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারলে তারা পয়সা জোগাতে পারে। তা ছাড়া তারা পয়সা জোগাতে পারে না। আমরা দেখেছি ব্যাপারটা সেখানেই। এখান থেকে তাদের একটা প্রতিনিধি গেল। সেখানে একটি সম্মেলন হলো। সেখানে আমাদের এমবাসি বা কাউকে তারা থাকতে দেয়নি। উপস্থিত হতে দেয়নি। সেখানে আপত্তিটা আমাদের দেশের লোক করেছে। আজকে র‌্যাবের বিরুদ্ধে যে বদনাম, এ জন্য অন্যদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের দেশের লোক বদনামটা করে। এই র‌্যাবের বিরুদ্ধে বদনাম তো আমার দেশের মানুষ করে যাচ্ছে। এ জন্য বলার কিছু নেই। আর সে জন্য এই স্যাংকশনটা এসেছে।’

মানুষ ভোট দিতে পেরেছে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূরক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নির্বাচন, বিএনপির আন্দোলন নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন যাতে না হয়, তার জন্য নানা ষড়যন্ত্র ছিল। ২০১৮–এর নির্বাচনে ‍দুপুর ১২টায় বিএনপি সরে যায়।

বিএনপির অবরোধ এখনো আছে এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আন্দোলন করে জনগণের সাড়া পেল না কেন? আমি যদি সত্যি ভোট নিয়ে খেলতাম, সত্যিই মানুষের ভোট ছিনতাই করে নিতাম, তাহলে তো ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সময়ে যেভাবে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আন্দোলন করেছিল, দেড় মাসের মধ্যে সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে ছিল, সেভাবে আমাদের হটাত! মানুষ তো সেভাবে সাড়া দেয়নি। কারণ, মানুষ তো ভোট দিতে পেরেছে। ভোটের যতটুকু উন্নতি, সেটা আমরা করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের কিছু কিছু লোক সব সময় একটা অস্বাভাবিক অবস্থা চায়। কারণ, অস্বাভাবিক অবস্থা থাকলে তাদের একটু গুরুত্ব বাড়ে।

সংসদ নেতা বলেন, ‘আমাদের একটা গোষ্ঠী আছে, তাদের খাবার দিলেও ঘুরিয়ে খায়। যতই করুন, তাদের কিছু ভালা লাগবে না। তারা বাংলাদেশের দারিদ্র্য না দেখালে এনজিওর টাকা পায় না। বন্যা না দেখালে তাদের কনসালটেন্সি আসে না। নিজেদের ক্রিম কীভাবে পাবে, এটা তাদের কাছে বড় কথা।’

রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় থাকবে

জাতীয় পার্টির সাংসদ ফখরুল ইমামের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করায় বাজারে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। তিনি আশা করেন, আসন্ন পবিত্র রমজান মাসেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম ২৬ দশমিক ৪১ শতাংশ, পাম তেলের দাম ৩৫ দশমিক ৭১ শতাংশ, অপরিশোধিত চিনির দাম ৮ দশমিক ২ শতাংশ, শিপিং ব্যয় ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। এর ঢেউ কিছুটা দেশেও লেগেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।

সংসদ নেতা বলেন, রমজান শুরুর আগে ও রমজানের মাঝামাঝি সময়ে দুই দফায় টিসিবির পণ্যসামগ্রী ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ অনুযায়ী জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নির্ধারিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে টিসিবির পণ্য বিক্রি করা হবে।

সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ভোজ্যতেলের ভ্যাট প্রত্যাহার, বাজার মনিটরিং, ওএমএস, পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার সংক্রমণ ও যুদ্ধের কারণে সব দেশেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৮০ ভাগ দাম বেড়েছে। এক ডলারের তেল চার ডলার দিয়ে কিনতে হচ্ছে। উন্নত দেশে কত শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে গেছে। মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। কিন্তু দেশে কেউ তো না খেয়ে মারা যায়নি। মানুষ অভাবের তাড়নায় কষ্ট পায়নি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী জিনিসের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব দেশেও পড়েছে। আর কিছু লোক আছে, যারা সুযোগটা নেওয়ার চেষ্টা করে। সেটা যাতে নিতে না পারে, তার জন্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ে সংসদ গরম করা হলো, সেই জন্যই আমি যখন প্রশ্নগুলো (তারকা চিহ্নিত প্রশ্ন) পেলাম, এটা ১ নম্বরে নিয়ে আসলাম। ভাবলাম যে আজকে উত্তর দিব।’

বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, আমাদের বিরোধী দলের একজন সদস্য (বিএনপির হারুনুর রশীদ), তিনি আজকে নেই। থাকলে ভালো হতো। তিনি বললেন যে খেজুর রিকশাওয়ালারা কিনবে না। রিকশাওয়ালারা খেজুর খাবে না কেন? আমরা কিন্তু প্যাকেজে খেজুর সব জায়গায় দিচ্ছি না। কিছু ঢাকা শহরে রাখা হয়েছে, যেটা টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে আনন্দের দিন

সম্পূরক প্রশ্নে জাতীয় পার্টির সাংসদ ফখরুল ইমাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাঁর জীবনের একটি আনন্দের স্মৃতির কথা জানতে চান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গুচ্ছগ্রাম তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল দেশের কোনো মানুষ গৃহহীন, ভূমিহীন ও ঠিকানাবিহীন থাকবে না। সে লক্ষ্য পূরণে বর্তমান সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার কথা তুলে ধরে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার জীবনে সব থেকে বড় আনন্দের দিন। একজন মানুষ, যার কিছু ছিল না, তাকে একটা ঘর দিয়ে তার মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। এর থেকে বড় আনন্দের কিছু হতে পারে না। সেদিন আনন্দে চোখের পানি রাখতে পারিনি। আমি অঝোরধারায় কেঁদেছিলাম। কারণ, এটাই তো আমার বাবার স্বপ্ন ছিল।’

এখন অনেকের ঘরে ফ্রিজ, টেলিভিশনসহ নানান আসবাব দিয়ে সাজানো হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘একটা মানুষকে যে ঠিকানা দিতে পেরেছি, জীবনটাকে পাল্টে দিতে পারলাম, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে।’