বাংলা ভাষার শত্রু-মিত্র কারা, বাংলা ভাষার বর্তমান পরিস্থিতি কী—এ বিষয়গুলো নিয়ে সম্প্রতি প্রথম আলো আয়োজন করেছিল এক আলোচনার। সেখানে কথা বলেছেন দুজন ভাষা বিশ্লেষক মহাম্মদ দানীউল হক ও মোহাম্মদ আজম। আলোচনাটি সঞ্চালনা করেছেন শিবব্রত বর্মন

শিবব্রত বর্মন: ভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও ভাষানীতি—এই বিষয়গুলো নিয়ে আজ কথা বলব আমরা। বাংলাদেশের বর্তমান ভাষা-পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করবেন দুই প্রজন্মের দুজন—জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। প্রথমজন প্রবীণ, দ্বিতীয়জন নবীন। নবীন-প্রবীণের এই আলাপের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার বর্তমান চিত্রটি বুঝে নিতে চাই আমরা।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে দু-একটি কথা বলি: ফেব্রুয়ারিকে আমরা বলি ‘ভাষার মাস’। এই মাস এলেই আমরা মাতৃভাষা নিয়ে উদ্বেল হয়ে উঠি। রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা লড়াই করেছি, রক্ত দিয়েছি। এখন বলছি সর্বস্তরে বাংলা চালু করার কথা। আমরা মনে করি, এ বিষয়ে সবার মধ্যে একটা দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার আছে। কিন্তু ‘বাংলা চালু’ কথাটি দিয়ে আমরা আসলে কী বোঝাই? এর অর্থ কি সবার কাছে সমান? ভাষানীতির কথা যে বলছি, সেটাই বা কী? এর পরিধি বা চৌহদ্দি কত বড়? ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো আপনারা কীভাবে দেখেন?
মহাম্মদ দানীউল হক: ভাষানীতি কথাটা খুব বড় মাপের। এর বিস্তার অনেক বড়। ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে বুঝি, ভাষানীতি ছাড়াও আরেকটা জিনিস আছে, সেটা হলো ভাষা পরিকল্পনা। আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, বাংলাদেশে অনেক কিছুই আছে, কিন্তু ভাষা পরিকল্পনা নেই। এই শব্দ আমাদের দেশে অপরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিপাইন তাদের ভাষা সমস্যা নিয়ে নানা রকম চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল। আটঘাট বেঁধে একটা ভাষা পরিকল্পনা ঠিক করেছে তারা। এখন তারা ভালো একটা অবস্থানে চলে এসেছে। আমাদের আরও কাছের দেশ মালয়েশিয়া ১৯৫৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পরপরই একটা ভাষা পরিকল্পনা তৈরি করে। এরপর তারা অনেক উন্নতি করেছে। আপনি ভাষানীতির কথা বললেন, এ নিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলবে, আমাদের তো একটা ভাষানীতি আছেই। যেমন বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। মাত্র তিনটি শব্দে আমাদের সংবিধানে ওটা লেখা আছে। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, প্রয়োজনে আমরা ইংরেজি এবং অন্য ভাষা ব্যবহার করব। কিন্তু ভাষানীতি আরও অনেক বিস্তৃত ব্যাপার। এর অনেকগুলো স্তর ও ক্ষেত্র আছে। একটা ক্ষেত্র হলো শিক্ষা। আরেকটা ক্ষেত্র দাপ্তরিক কাজ। এ ছাড়া আছে জনজীবন। আছে সংস্কৃতি। তারপরে আসবে সাহিত্য ও সৃষ্টিশীল জগৎ। এখানে শুরুতে একটা কথা হলো, ‘ভাষার মাস’। প্রশ্ন হলো, ভাষার আলাদা মাস থাকতে হবে কেন? ফেব্রুয়ারি এলে আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ব, নানা রকম অনুষ্ঠান করে অঙ্গীকার করব, কিন্তু ফেব্রুয়ারি চলে গেলেই শেষ! এটা হতে দেওয়া উচিত নয়। আমরা এখনো জানি না, আমাদের ভাষানীতিটি কী হওয়া উচিত। এর কারণ আমরা কোনো পরিকল্পনা করিনি যে পাঁচ বছরে এটি করব, দশ বছরে এটি করব, পনেরো বছর পরে গিয়ে এই হবে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষা এতটুকু কাজ করবে।আমরা একসময় ঠিক করলাম, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা—এ পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হবে বাংলা ভাষায়। তবে এখন দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক থেকেই প্রায় ইংরেজিতে চলে যাচ্ছি। শিক্ষার তিনটি ধারা আমরা চালু রেখেছি। ফলে দেখা যাচ্ছে, আমরা আবেগ যতটা প্রকাশ করি, তার প্রয়োগ ততটা করি না। কী বলেন আজম?
মোহাম্মদ আজম: দানীউল হক স্যার যেটা বললেন, আমারও তাই মনে হয়—আবেগটা খুব বেশি দেখা যাচ্ছে, প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। বেশ কিছুদিন ধরে আমি বলে বা লিখে আসছি যেবাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের প্রধান সমস্যা আদতে এটাই। বাংলাকে আমরা মনে করি আবেগের বিষয়। আর ইংরেজিকে মনে করি প্রয়োজনের বিষয়। যদি আমরা বাংলাকে প্রয়োজনের বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে না পারি, তাহলে এই সমস্যার সমাধান আসলে হবে না। বাংলা ভাষাকে আমরা একটা রাজনৈতিক প্রসঙ্গ হিসেবে কখনো দেখতে পারিনি। কিন্তু ভাষা আদতে একটা রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, এই অর্থে যে ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে আপনি ভাষার মর্যাদা বা ‘স্ট্যাটাস’ কোথায় রাখবেন—এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বাংলা ভাষাকে আমরা আবেগের দিক থেকে সম্মান দিয়েছি। স্ট্যাটাসের দিক থেকে দিতে পারিনি বা দিইনি। একটা রাষ্ট্রে ভাষা সম্মানজনক অবস্থানে আছে কি না, এটা আপনি বুঝবেন তিনটি জায়গা থেকে। এক, উচ্চশিক্ষায় ভাষাটা ব্যবহার হচ্ছে কি না। দুই, উচ্চ আদালতে ব্যবহার হচ্ছে কি না। তিন, দপ্তরে—যেখানে সম্মানসূচক কিংবা মর্যাদাবাচক যোগাযোগ করতে হয়, সেখানে ভাষাটা ব্যবহার হচ্ছে কি না। আমি একেবারে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এই তিন ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার হয় না। সুতরাং বাংলার মর্যাদা নিয়ে এখানে যা কিছু বলা হয়, সবই বাখোয়াজি। কোথাও বাংলা নেই।
শিবব্রত: এখন এই নেইয়ের চেয়েও খারাপ যা হয়েছে, তা হলো আমাদের একদল মনে করতে শুরু করেছে, থাকাটি সম্ভবও না।
আজম: আমাদের সংবিধানে তো আমরা ভাষার মর্যাদা দিয়েই দিয়েছি। এর চেয়ে বড় নীতি, বড় পরিকল্পনা আর কী হতে পারে?
দানীউল: ঠিক। নীতি আসলে আমাদের নির্ধারণ করাই আছে।
শিবব্রত: তাহলে কি ঘাটতিটি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের?
আজম: রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিষয় নয়, ভাষা নিজেই একটা রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। কেননা, এটা রাষ্ট্রের ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। রাষ্ট্রের ক্ষমতা কোন শ্রেণির হাতে থাকবে, তারা নিজের আর নিজের সন্তানদের ভবিষ্যৎকে কীভাবে দেখে—এগুলোর সঙ্গে যুক্ত। আপনি যে রাষ্ট্র চালান বা যে কাঠামো পরিচালনা করেন, তাতে আপনি কাকে অন্তর্ভুক্ত করবেন, কাকে বাইরে রাখবেন, তার সঙ্গে যুক্ত। পরিষ্কার কথা। আপনি দেশকে যদি দশ লাখ বা এক কোটি লোক দিয়ে চালাতে চান, তাহলে ইংরেজি যথেষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশ যদি ষোলো কোটি মানুষের রাষ্ট্র হয়, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এখানে অকার্যকর। কেননা, এতে পনেরো কোটি লোকের প্রবেশাধিকার নেই।
দানীউল: এখানে আজম যে মর্যাদা ও পরিকল্পনার কথাটা তুললেন, ভাষাবিজ্ঞানে বলা হয়, পরিকল্পনার দুটো দিক আছে। একটা হলো অবয়ব পরিকল্পনা, আরেকটা মর্যাদার পরিকল্পনা। একটা ‘স্ট্যাটাস’, আরেকটা ‘কর্পাস’। মর্যাদার ব্যাপারটাকে এই পর্যায়ে নেওয়া সম্ভব যে, যে জায়গায় বাংলা ভাষা ব্যবহার করা যেত, সেখানে কেউ অন্য ভাষা ব্যবহার করলে তা শাস্তিযোগ্য হবে। কিন্তু আইন-কানুনের প্রয়োগকারীরা যত দিন না এই মর্যাদাবোধ ধারণ করবেন, তত দিন কিছুই হবে না।
আজম: আগের কথায় ফিরে যাই, আবেগ ও প্রয়োগ—এ দুটি কথার মধ্যে আমরা খুবই গোলমাল করে ফেলেছি। আমাদের পুরো মুক্তিযুদ্ধের ডিসকোর্সটা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে উৎসারিত হলেও আমরা সেটাকে আর রাষ্ট্রভাষার মধ্যে রাখিনি। যেটা ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, সেটাকে আমরা বানিয়েছি মাতৃভাষা আন্দোলন। আপনি চূড়া থেকে পাতালে চলে এসেছেন। মজার ব্যাপার হলো, এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো সচেতনতাও নেই।
মাতৃভাষা নিয়ে পৃথিবীর কোথাও কোনো বিরোধ নেই। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ মাতৃভাষা নিয়ে ছিল না। আমাদের আন্দোলন ছিল রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। আমরা সেখান থেকে বিচ্যুত হয়েছি। এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করে রাষ্ট্রের যে অহমিকা প্রকাশ পাচ্ছে, এটা ভেগ (ঘোলাটে)। ভাষার ব্যবহারগত দিক থেকেও এটা ভেগ।
দানীউল: ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন যখন চলছিল, আমি তখন সবে স্কুলে যাচ্ছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, বলা হচ্ছিল: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দু-বাংলা ভাই ভাই’। বলা হয়নি যে কেউ উর্দু ব্যবহার করতে পারবে না। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাটা চাওয়া হয়েছিল।
আজম: কেন? পরিষ্কার কথা হলো যে এখানে কৃষকের ছেলেপেলেরা, যারা উর্দু ও ইংরেজি জানে না, এই সিদ্ধান্তের কারণে তারা চাকরি পাবে অথবা পাবে না। এটা তাদের জীবন-মরণ সমস্যা। এটা ছিল তখনকার বাস্তব পরিস্থিতি। ওই ডিসকোর্স ব্যবহার করে রাষ্ট্র বানিয়ে আপনি এখন সেটাকে বাদ দিলেন কেন? কারণ আপনি অল্প কিছু লোকের জন্য রাষ্ট্র বানিয়েছেন। আপনি যদি ষোলো কোটি লোকের দেশ গড়তে চান, তার একমাত্র উপায় হলো, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
শিবব্রত: কিন্তু বায়ান্ন সালে যেটা প্রায়োগিক দিক থেকে দরকার ছিল—অর্থাৎ বাংলা রাষ্ট্রভাষা—সেই প্রয়োজনটি কি ফুরিয়ে গেছে? পরিবর্তনটি কেন হলো? আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো তো ৯০ শতাংশ কৃষকের সন্তানেরাই পড়াশোনা করছেন।
আজম: এখন ৯০ শতাংশের চেয়েও বেশি।
শিবব্রত: তাহলে বায়ান্ন সালের পরিস্থিতিই যদি বহাল থাকে, সে ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা এল কেন? কীভাবে এল? রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রয়োজন ফুরাল কেন?
আজম: এর সহজ জবাবটা চরমপন্থীর মতো শোনাবে। আপনি যদি একটা রাষ্ট্র তৈরি করতে চাইতেন, তাহলে আপনি বাংলার প্রয়োজন বোধ করতেন। কিন্তু আপনি একটা রাষ্ট্রকাঠামোকে ব্যবহার করে সংকীর্ণ গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করতে চান, সে কারণেই আপনি আর বাংলার প্রয়োজন বোধ করেন না। বাংলার প্রয়োজন আগের চেয়ে বেড়েছে। ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটাও উদাহরণ নেই, যারা দ্বিতীয় ভাষা ব্যবহার করে উন্নতি করেছে। এশিয়ার যে দেশগুলোকে আমরা উন্নত দেশ বলি, তার মধ্যে একটাও নেই যারা দ্বিতীয় ভাষা দিয়ে উন্নতি করেছে। চীনের গণমানুষ এক বর্ণও ইংরেজি জানে না।
শিবব্রত: ওখানে ইংরেজিতে পানি চাইলে কেউ পানি দিতে পারে না...
আজম: আমি ঢাকায় চীনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল দেখেছি, ইংরেজিতে কথা বলতে জানে না। বড়পুকুরিয়ার প্রধান প্রকৌশলীকে দেখেছি দোভাষীর সাহায্যে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিতে। জাপানিরা চীনাদের চেয়ে একটু ভালো ইংরেজি জানলেও তারা জনসাধারণের মধ্যে সেটা ব্যবহার করে না। পৃথিবীতে এমন কোনো উদাহরণ নেই, যারা দ্বিতীয় ভাষা ব্যবহার করে উন্নতি করেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো ভারত। কিন্তু ভারতের ভাষা পরিস্থিতি আর বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতি একদম ভিন্ন। ভারতে ২ শতাংশ লোকের মাতৃভাষা ইংরেজি। ভারতে প্রধান ভাষা আছে কমপক্ষে ৩০টা। এই বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ওখানে ইংরেজির একটা ভালো জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আপনাকে এ-ও খেয়াল রাখতে হবে, ওরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দিকে দারুণভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, প্রচারও করে।
দানীউল: এই কথার সূত্র ধরে বলি, ভারত একটা ত্রিভাষিক নীতি গ্রহণ করেছে। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু থাকতে এটা হয়েছে। নীতিটি হলো, প্রথম ভাষা হবে হিন্দি, দ্বিতীয় ভাষা হবে যে অঞ্চলে কাজটা হবে সেই অঞ্চলের ভাষা এবং তৃতীয়টি হবে ইংরেজি।
আজম: বাংলাদেশে কিন্তু এখন বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে পিছিয়েছে। ‘ইংলিশ ভার্সন’ বলে আরও খারাপ একটা জিনিস এসেছে। যেহেতু ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা ব্যয়বহুল, মধ্যবিত্তের এই খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই, তাই ইংলিশ ভার্সন বলে এক বস্তু চালু হয়ে গেছে। ফলে বাংলা কিন্তু আর বাংলাদেশের শিক্ষামাধ্যমে নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্র যারা একেবারেই এই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার খরচ বহনে অপারগ, তারা বাংলা পড়ছে; বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়েই পড়ছে। ফলে শ্রেণিগতভাবে বাংলা শুধু পিছিয়ে পড়া নয়, বাদ পড়ে গেছে। সব লোককে যেহেতু ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করা সম্ভব নয়, এ কারণে শিক্ষাটা দিতে হবে বাংলায়।
শিবব্রত: মোহাম্মদ আজমের কথায় ভাষার রাজনীতিটা পরিষ্কার। এই প্রেক্ষাপটে একটা প্রশ্ন করি। সর্বস্তরে বাংলা চালু করার মাধ্যমে ক্ষমতাকাঠামোয় সবার ভাগ বসানো নিশ্চিত করার প্রকল্পটি উল্টোভাবে করা যায় কি না। মানে ধরুন, ৯০ শতাংশ মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা গেলে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়ে যাবে কি না।
দানীউল: না সেটা হবে না।
আজম: রাজনীতি আসলে সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোর খোপগুলোর সমষ্টিমাত্র। রাজনীতি কখনোই পরিবর্তন হবে না, যদি ওই খোপগুলো পরিবর্তন না হয়। সুতরাং রাজনীতি পরিবর্তন করে আপনি ভাষা পরিস্থিতি বদলাবেন, এটা সম্ভব নয়। আপনাকে আগে বিভিন্ন জায়গায় পরিবর্তন ঘটাতে হবে, তাতে রাজনীতির পরিবর্তন ঘটবে।
দানীউল: যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আবেগ আর প্রয়োগকে এক করতে না পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু হবে না।
আজম: মনে হতে পারে, আমরা ইংরেজির বিরুদ্ধে কথা বলছি। কিন্তু আমার দিকটা আমি পরিষ্কার করি। ঔপনিবেশিক কারণেই হোক আর অন্য যেকোনো কারণেই হোক, আমাদের মধ্যে এ রকম একটা ধারণা দাঁড়িয়ে গেছে যে ইংরেজি শিখলে উন্নতি করা যায়। আমি সেই ধারণা ভেঙে দিতে রাজি নই। রাষ্ট্র যদি মনে করে নাগরিকদের আরও ইংরেজি শেখানো দরকার, আরও বিনিয়োগ করা দরকার, রাষ্ট্র তা করতে পারে। এখন ইংরেজিতে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা আছে, এর বদলে ৪০০ নম্বরের পরীক্ষা চালু করতে পারে। কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হতে হবে। ওটা ইংরেজি হতে পারে না। আপনি তো ইংরেজি ও বাংলাকে বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। আপনাকে সমান্তরাল করতে হবে। লোকে ইংরেজি শিখতে চায়, শেখান।
শিবব্রত: যেমন আমাদের চীনা ভাষাও শেখা দরকার...
আজম: একেবারে ঠিক কথা। আপনি ১০০ ভাষা শেখান। কিন্তু কিছুতেই বাংলার বিকল্প ইংরেজি হতে পারে না।
দানীউল: আবেগ আর প্রয়োগের পাশাপাশি আমি আরেকটি ব্যাপারে জোর দিতে চাই। অভ্যাসের একটি বিষয় আছে। যেকোনো বিখ্যাত ব্যক্তির ভাষণ আপনি শুনুন, যেখানে একটি ভালো বাংলা শব্দ ব্যবহার করা যায়, বাক্য ব্যবহার করা যায়, অভ্যাসবশে তিনি সেখানে অন্য ভাষা ব্যবহার করেন। বিদ্যালয় পর্যায় থেকেই এই অভ্যাসের পরিবর্তন আনতে উৎসাহিত করতে হবে। অভ্যাসের পরিবর্তন না আনলে আবেগ আর প্রয়োগ এক করা যাবে না।