রাসায়নিক গুদামগুলোর কোনো অনুমোদন ছিল না

বিস্ফোরণে তিনটি রাসায়নিক গুদামের একটি পুরোপুরি ও অন্য দুটির আংশিক ধসে পড়েছে। ছবি: প্রথম আলো
বিস্ফোরণে তিনটি রাসায়নিক গুদামের একটি পুরোপুরি ও অন্য দুটির আংশিক ধসে পড়েছে। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন পূর্ব বন্দ ডাকপাড়া এলাকার তিনটি রাসায়নিক গুদামে আজ রোববার বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে একটি গুদাম পুরোপুরি ও অন্য দুটির আংশিক ধসে পড়েছে। বিস্ফোরণের কম্পনে আশপাশের ৮ থেকে ১০টি বাড়ির দেয়াল ও জানালার কাচ ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ১০ জন। কেরানীগঞ্জের ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আধা ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এখানে গোডাউন করার কোনো অনুমোদন ছিল না বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

গোডাউনের আশপাশের বাড়ির লোকজন জানিয়েছেন, গুদামের মালিক পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মারুফ হোসেন। প্রায় ১০ বছর আগে এখানে নিজস্ব জমিতে আধা পাকা ভবনে তিনটি রাসায়নিক গুদাম স্থাপন করেন তিনি। ঘটনার পর থেকে পুলিশ তাঁকে খুঁজছে।

এ ঘটনায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কেরানীগঞ্জ সার্কেল কামরুল হাসান সোহেলকে আহ্বায়ক ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।


আহত ১০ জনের মধ্যে ৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন হালিমা বেগম (৩০), মিম আক্তার (১২), নুরু মিয়া (৩২), তানসির ইসলাম (৬), পান্না বেগম (২৮), সুরুজ মিয়া (৩৫) ও বিলকিস বেগম (২৩)।

ঘটনাস্থল থেকে ১৫-২০ গজ দূরে তিনতলা বাড়ি নাসিরউদ্দিনের। তিনি জানান, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ তাঁর বাড়িসহ আশপাশের ঘরবাড়িগুলো ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে। চারদিকে ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। ঘরের জানালার কাচ ও আসবাবপত্র ভেঙে পড়ে। এ সময় বাড়ির আশপাশের লোকজন চিৎকার শুরু করলে তিনিও পরিবার–পরিজন নিয়ে দৌড়ে নিচে নামেন। তিনি আবাসিক এলাকা থেকে এ ধরনের গোডাউন সরানোর দাবি জানান।

কারখানার পার্শ্ববর্তী বাড়ির মালিক বাবুল মিয়া বলেন, তাঁর আধা পাকা টিনশেডের বাড়িতে ১৪ জন ভাড়াটে বসবাস করে। রাসায়নিক গুদামের বিস্ফোরণে বাড়ির দেয়াল ধসে পড়েছে এবং ঘরের চালা আংশিক পুড়ে গেছে। এ ছাড়া ঘরের পাখা দুমড়েমুচড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণের কারণে বাড়ির ভাড়াটে জুম্মন মিয়ার স্ত্রী হালিমা বেগম (৩০) পায়ে আঘাত পেয়েছেন এবং খোকনের মেয়ে মিম আক্তার (১২) শরীরে আগুনের ফুলকি লেগে আহত হয়েছে।

কদমতলী গোলচত্বর এলাকার বাসিন্দা হালিম মোটরসের ব্যবস্থাপক কাওসার হোসেন বলেন, ‘দুপুর সাড়ে ১২টার পর হঠাৎ দেখি পশ্চিম দিকের আকাশে কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটনা ঘটেছে, সেখান থেকে আমাদের মার্কেটের দূরত্ব প্রায় ৫০০ গজ। এ সময় দু–তিনটি ইট উড়ে এসে আমাদের মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় জানালার গ্লাসে লাগে। এতে জানালার কাচ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এ সময় পথচারীরা এদিক–সেদিক ছোটাছুটি করে।’

গোলামবাজার সড়ক এলাকার সাহাবুদ্দিন মার্কেটের প্রচার অ্যাড মিডিয়ার কর্মচারী তানভীর হোসেন বলেন, ‘দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো আমাদের মার্কেটের ভবন কাঁপতে থাকে। তখন আমিসহ দোকানের অন্যান্য কর্মচারী দৌড়ে বাইরে চলে আসি। তখন আচমকা ইটের কয়েকটি টুকরা উড়ে এসে আমার পায়ে পড়ে। এতে পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পাই।’

ফয়ার সার্ভিসের লোকজন আধা ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ছবি: প্রথম আলো
ফয়ার সার্ভিসের লোকজন আধা ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ছবি: প্রথম আলো

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মো. মোস্তফা মোহসীন বলেন, দুপুর ১২টা ১৯ মিনিটে আগুন লাগার খবর পান। তৎক্ষণাৎ কেরানীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তিনি আরও বলেন, এ গোডাউনে সোডিয়াম থায়ো ম্যাঙ্গানিজ, সালফেট মনোহাইড্রেট ও ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড ছিল। সোডিয়াম থায়ো–জাতীয় পদার্থ গুদামজাত করা ছিল। তবে কী কারণে বিস্ফোরণের সূত্রপাত ঘটেছে, সেটি তদন্তের পরে জানা যাবে। এখানে গোডাউন করার কোনো অনুমোদন ছিল না।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অমিত দেবনাথ বলেন, আবাসিক এলাকায় এ ধরনের রাসায়নিক গুদাম করার কোনো অনুমোদন নেই। বাড়ির মালিক বসবাসের জায়গায় অবৈধভাবে রাসায়নিক গুদাম গড়ে তুলেছে। তিনি আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে কেরানীগঞ্জে প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এরপর থেকেই আমরা কারখানার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তার ব্যাপারে তাঁদের সোচ্চার হয়েছি। আমরা ইতিমধ্যে কেরানীগঞ্জের আবাসিক এলাকার বাড়ির মালিকদের জানিয়ে দিয়েছি, তাঁরা যেন তাঁদের বাড়িতে কোনো রাসায়নিক কারখানা কিংবা গুদাম ভাড়া না দেন।’

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, ‘আমার এলাকায় কোনো অবৈধ কারখানা বা গোডাউন থাকবে না। আমি ইতিমধ্যে কেরানীগঞ্জের সব ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়ে আলোচনা করেছি। অবৈধ কারখানা ও গোডাউনের তালিকা করে এগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মইনুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, রাসায়নিক গুদামগুলোর মালিক পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মারুফ হোসেন। তাঁকে আটকের জন্য পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে।