রূপপুরের সঙ্গে দুশ্চিন্তা বাণিজ্য নিয়েও

পাবনায় অবস্থিত ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সিংহভাগ অর্থের জোগান দিচ্ছে রাশিয়া।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক লেনদেন-ব্যবস্থা সুইফট থেকে দেশটির কয়েকটি ব্যাংককে বের করে দেওয়ায় বাংলাদেশ নানা দিক দিয়ে বিপাকে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, শুধু রূপপুর নয়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ এবং আমদানি-রপ্তানিতেও এর প্রভাব পড়বে।

রাশিয়ার ১২টি ও বেলারুশের ২টি ব্যাংককে সুইফট থেকে তালিকাচ্যুত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা ১২ মার্চ কার্যকর হবে। এর মধ্যে একটি ব্যাংকের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থ লেনদেন হতো। ব্যাংক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফরেন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স (ভিইবি) নামের রাশিয়ার ওই ব্যাংক কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে সুইফট ব্যবস্থার মাধ্যমে পাঠানো একটি বার্তায় আপাতত তাদের সঙ্গে লেনদেন করতে নিষেধ করেছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা অন্যান্য ব্যাংকের কাছ থেকেও বাংলাদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে এমন বার্তা এসেছে।

এর কী প্রভাব পড়তে পারে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুইফটের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়া ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আমাদের যত আমদানি ও রপ্তানি ঋণপত্র আছে, সবই আটকে যাবে। রাশিয়া বিশ্ব লেনদেন-ব্যবস্থা থেকে পুরোপুরি তালিকাচ্যুত হলে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পও আটকে যেতে পারে। কাজ আটকে গেলে এর ভবিষ্যৎ কী, তা অনিশ্চিত।’ তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২-এর কথা আমাদের ভুলে যাওয়াই ভালো।’

সেলিম রায়হান আরও বলেন, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমারা পরবর্তী সময়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, সেটাও দেখতে হবে। সামনে একের পর এক ধাক্কা আসবে। এখন আর এসব উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য নীতি-কৌশলে আরও সুসংহত হতে হবে।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় রূপপুর প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনেকটাই এগিয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে ২০২৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হওয়ার কথা। ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে ৯১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। নিষেধাজ্ঞা-পরবর্তী অনিশ্চয়তা নিয়ে গত মঙ্গলবার রাশিয়ার পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটম অবশ্য বলেছে, রূপপুরের কাজে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে না।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ প্রকল্পটি নতুন। গত মাসে দেশের দ্বিতীয় কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণে রুশ প্রতিষ্ঠান গ্লাভকসমসের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত মহাকাশ সংস্থা রসকসমসের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান গ্লাভকসমস। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সমঝোতা কতটা এগোবে, তা নিয়েই সংশয় বিশ্লেষকদের।

রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। এরপর পশ্চিমারা নানামুখী নিষেধাজ্ঞা জারি শুরু করে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গতকাল শুক্রবার আর কোনো নিষেধাজ্ঞা না দিতে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা ইতিমধ্যে সংকটে পড়ে গেছেন। ব্যবসায়ী ও ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, একদিকে যেমন ঋণপত্র খুলতে সমস্যা হচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়ার বাজারে পোশাকের চাহিদায় ধস নেমেছে।

বাংলাদেশ ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাশিয়ায় প্রায় ৪৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৬৬ কোটি ডলারে, প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩৭ শতাংশ। রপ্তানি বেশি হয় পোশাক। ২০২০-২১ অর্থবছরে রাশিয়ার কাছ থেকে ৪৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের গমের বড় উৎস রাশিয়া। দেশটি থেকে ভুট্টাও আসে।

জানতে চাইলে খাদ্যশস্য আমদানিকারক চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়া থেকে ৯০ শতাংশ পণ্য আনা হয় সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশের বিক্রেতাদের মাধ্যমে। ওই বিক্রেতারা এখন রাশিয়ার পণ্যের বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছে না।

বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশের ১১ হাজার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুইফটের সঙ্গে যুক্ত। সুইফটের মাধ্যমে পুরো বিশ্বের ৯০ শতাংশ লেনদেন সম্পন্ন হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর বিকল্প লেনদেন মাধ্যম গড়ে তোলা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। সুইফটের বিকল্প হিসেবে চীনা মুদ্রায় ব্যবসা করা যায়। তবে ওই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বিশ্বের বড় ব্যাংকগুলোর সম্পর্ক নেই। আবার চীনা মুদ্রায় ব্যবসা করতে গেলে তা-ও পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে। ফলে ঝুঁকি আছেই। নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকা রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে লেনদেন করাও বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে সেটাও নির্ভর করছে সময় ও পরিস্থিতির ওপর।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, হয়তো বিকল্প চ্যানেলে লেনদেন চালু হবে, কিন্তু তাতে খরচ ও ঝুঁকি বাড়বে। আবার বিকল্প চ্যানেলে লেনদেন হলে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হবে, সেটাও দেখতে হবে।

সেলিম রায়হান আরও বলেন, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমারা পরবর্তী সময়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, সেটাও দেখতে হবে। সামনে একের পর এক ধাক্কা আসবে। এখন আর এসব উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য নীতি-কৌশলে আরও সুসংহত হতে হবে।