অভিযান–১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড
লঞ্চে ত্রুটি পেয়েছে তদন্ত কমিটি
অগ্নিকাণ্ডের কারণ কী, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ইঞ্জিন রুম থেকেই আগুন লেগেছে বলে ধারণা।
এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের কারণ কী, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকেই আগুন লেগেছে বলে মনে করা হচ্ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, লঞ্চের ইঞ্জিনেও ত্রুটি ছিল। তদন্ত দলের সদস্যরা গতকাল শনিবার ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতীরে নোঙর করে রাখা পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শন করেছেন।
তদন্ত দলের প্রধান নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. তোফায়েল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ইঞ্জিনে কিছু ত্রুটি পেয়েছি।’
এ ছাড়া কাগজে-কলমে লঞ্চটি যে মাস্টারের (চালক) চালানোর কথা ছিল, তিনি চালাচ্ছিলেন না বলেও জানা গেছে। লঞ্চে মাস্টার নিয়োগের বিষয়টি নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে অবহিত করতে হয়।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার মাহবুব রশিদ গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, অভিযান-১০ লঞ্চের চারজন মাস্টার ও ড্রাইভারের মধ্যে তিনজনের নিয়োগের বিষয়টি মালিক অধিদপ্তরকে জানাননি। লঞ্চটির সার্ভে সনদে প্রধান মাস্টার হিসেবে যাঁর নাম আছে, তাঁর পরিবর্তে অন্য এক মাস্টার লঞ্চটি চালাচ্ছিলেন। এটি নিয়মের ব্যত্যয়। লঞ্চমালিক মাস্টার ও ড্রাইভার পাল্টাতে পারেন। তবে সেটি করতে হবে নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে জানিয়ে।
* লঞ্চটি যে মাস্টারের চালানোর কথা ছিল, তাঁর পরিবর্তে চালাচ্ছিলেন আরেকজন। * লঞ্চটি ছাড়ার আগে বিআইডব্লিউটিএ যে ‘চেক লিস্ট’ করেছিল, তাতে উল্লেখ ছিল: লঞ্চে কোনো ত্রুটি নেই। * নৌ আদালতে মামলা হয়নি, ঝালকাঠিতে অপমৃত্যুর মামলা।
এদিকে তদন্ত দল জানতে পেরেছে, আগুন লাগার সময় লঞ্চটির প্রধান দরজা বন্ধ ছিল। যে কারণে জ্বলন্ত অবস্থায় লঞ্চটি নদীতীরের কাছে নোঙর করলেও যাত্রীরা প্রধান দরজা থেকে বের হতে পারছিলেন না। যে যেভাবে পেরেছেন, জানালা দিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৩৮ যাত্রী নিহত হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮৫ জন। নিখোঁজ রয়েছেন ৫১ জন।
অগ্নিনির্বাপণ সম্পর্কে জানেন না লঞ্চকর্মীরা
আগুন লাগলে তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সে বিষয়ে লঞ্চের কর্মীদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র থাকলেও তা কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেটিও জানেন না লঞ্চের কর্মীরা। ফলে চলন্ত অবস্থায় লঞ্চে আগুন লাগলে হয় পানিতে ঝাঁপ দিতে হবে, নয়তো উদ্ধারকারীদের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকার সদরঘাট স্টেশনের কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবু সায়েম প্রথম আলোকে বলেন, লঞ্চের কর্মীদের অগ্নিনির্বাপণযন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা নেই। এমনকি লঞ্চ ডুবে গেলে যাত্রীরা কীভাবে জীবন রক্ষাকারী বয়া (পানিতে ভেসে থাকার সরঞ্জাম) ব্যবহার করবেন, সে সম্পর্কেও তাঁরা ভালোভাবে জানেন না। আর বেশির ভাগ লঞ্চের মধ্যে বয়া এত শক্ত করে বাঁধা থাকে যে এগুলো প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করার মতো অবস্থা থাকে না।
বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সদরঘাট থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যে ২২১টির মতো যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলের অনুমতি রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৮৫টি লঞ্চ ঢাকা থেকে ছাড়ে।
সদরঘাট টার্মিনালে কর্মরত বিআইডব্লিউটিএর কর্মচারীদের জন্য অগ্নিমহড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আর মালিকেরা আবেদন না করলে লঞ্চের কর্মীদের জন্য অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা মহড়ার ব্যবস্থা ফায়ার সার্ভিস করে না। গত দুই বছরের মধ্যে শুধু ঢাকা-বরিশাল নৌপথে চলা এমভি মানামী লঞ্চে একবার অগ্নিমহড়া করা হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়।
নৌ অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধের মূল দায়িত্ব ঢাকার শ্যামপুরের বিআইডব্লিউটিএর ঘাটে অবস্থিত ‘রিভার ফায়ার স্টেশন’–এর। বিশেষ এ ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা মালেক মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড যাতে না ঘটে, সে জন্য তাঁরা সচেতনতামূলক প্রচার চালালেও কোনো মহড়া বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন না।
অভিযান লঞ্চের ইঞ্জিন রুমের সঙ্গেই ছিল রান্নাঘর। নিয়ম না মেনে সেখানে রান্নাঘর স্থাপন করা হয়। এ বিষয়ে সুন্দরবন-১১ লঞ্চের চালক আবদুস সালাম মৃধা বলেন, বড় লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে রান্নাঘরের দূরত্ব বেশি থাকলেও ছোট আকৃতির লঞ্চগুলোতে রান্নাঘর একদম লাগানো থাকে। রান্নার কাজে ব্যবহার করা গ্যাস সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
নৌপরিবহন অধিদপ্তর সূত্র বলছে, অভিযান–১০ লঞ্চের মালিক অনুমতি না নিয়ে লঞ্চের ইঞ্জিন বদলেছেন। আগে এ লঞ্চে ৫৫০ হর্স পাওয়ারের দুটি ইঞ্জিন থাকলেও তা পাল্টে ৭২০ হর্স পাওয়ারের দুটি ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে। নতুন ইঞ্জিন লাগানোর পর লঞ্চটির দ্বিতীয় যাত্রা শুক্রবার। এটিকে ‘ট্রায়াল ট্রিপ’ (পরীক্ষামূলক যাত্রা) বলা যায়।
তবে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাট টার্মিনাল ছাড়ার আগে বিআইডব্লিউটিএ যে ‘চেক লিস্ট’ তৈরি করেছিল তাতে বলা হয়েছিল, লঞ্চে কোনো ত্রুটি নেই। চেক লিস্ট অনুযায়ী, লঞ্চের যাত্রী ধারণক্ষমতা ৭৫০ জন, যা রাতে ৪২০ জন। তবে লঞ্চ ছাড়ার আগে যাত্রীসংখ্যা ৩১০ জন উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে যাত্রী ছিল অনেক বেশি। লঞ্চে ১২৫টি বয়া এবং ২০টি অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র থাকার কথা। তবে আগুন লাগার পর অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি।
নৌ–আদালতে মামলা হয়নি, ঝালকাঠিতে অপমৃত্যুর মামলা
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে ঝালকাঠি সদর থানায় মামলাটি হয়েছে।
আইন অনুযায়ী নৌদুর্ঘটনাবিষয়ক সব মামলা নৌ আদালতে দায়ের হতে হবে। নৌ আদালতে মামলার বাদী হবেন সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শক। গত রাত ১০টা পর্যন্ত নৌ আদালতে কোনো মামলা হয়নি বলে জানান নৌ আদালতের প্রসিকিউটিং অফিসার মুন্সী মো. বেল্লাল হোসাইন।
গতকাল ঝালকাঠিতে গিয়ে পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শন করেন সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এ ছড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির সদস্যরাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।