লাইসেন্সের জন্য ঘুরছেন ১৫ লাখ মানুষ

কাজ পেতে ঠিকাদারদের রেষারেষি থেকে অচলাবস্থার শুরু। কাজ পাওয়ার পর পাঁচ মাস চলে গেলেও কার্ড সরবরাহ শুরু করেনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।

মো. আশির মোল্লা যাবেন সৌদি আরব। তাঁর দরকার পেশাদার মোটরযান চালকের লাইসেন্স। লাইসেন্সের জন্য তিনি মিরপুরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-তে পরীক্ষা দেন ২০১৯ সালের এপ্রিলে। এরপর স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স পেতে সরকারি ফি জমা দেন। এক মাসের মধ্যে আঙুলের ছাপ ও ছবি তোলার কাজ শেষ হয়। বিআরটিএ তাঁকে একটি রসিদ দেয়। তাতে লাল সিলে লাইসেন্স সরবরাহের তারিখ লেখা ১৪ নভেম্বর ২০১৯। নির্ধারিত দিনে বিআরটিএতে গেলে রসিদে আরেকটি সিল পড়ে। এবার লাইসেন্স দেওয়ার তারিখ ২০২০ সালের ২৩ এপ্রিল। ওই তারিখে গেলে আরেকটি সিল পড়ে। তাতে লেখা ৫ জানুয়ারি ২০২১। এবার গিয়েও লাইসেন্স পাননি আশির। তাঁর রসিদে পুনরায় লাল সিল পড়ে। নতুন তারিখ আগামী ১৩ ডিসেম্বর। পৌনে তিন বছর পরও লাইসেন্স পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন আশির মোল্লা।

কেন এই সমস্যা? তথ্যানুসন্ধানে জানা গেল, ঠিকাদার নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা এবং দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে আশির মোল্লার মতো ১৫ লাখ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছেন বিআরটিএর কাছে। তাঁদের বেশির ভাগ দেড় থেকে আড়াই বছর ধরে বিআরটিএতে ঘুরছেন।

গত ৩০ মে মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে কথা হয় আশির মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব যেতে ঋণ আর সঞ্চয় বিনিয়োগ করে ফেলেছি। চারবার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার তারিখ বদলেছে তারা। এখন ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করার মতো অবস্থায় আমি নেই। আমার তো পথে বসার উপক্রম।’

একই দশা সিলেটের আশরাফ হোসেনের। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরব থেকে তাঁর জন্য চালকের ভিসা প্রস্তুত করা আছে। চালকের লাইসেন্স না পাওয়ায় পাসপোর্টে ভিসা সংযুক্ত করতে পারছেন না। ঠিক সময়ে লাইসেন্স পেলে এত দিনে সৌদি আরবে থাকতেন। আশরাফ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর বিআরটিএতে গিয়ে লাইসেন্সের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। গত বছরের অক্টোবরে লাইসেন্স দেওয়ার কথা ছিল। এখন সময় বাড়িয়ে আগামী ১৮ অক্টোবর করা হয়েছে।

জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান জানান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গাড়িচালকের চাহিদা অনেক। থাকা-খাওয়ার সুবিধা এবং বেতনও ভালো। কিন্তু এই ভিসার খরচ অন্য ভিসার প্রায় অর্ধেক। অন্য পেশার ভিসায় প্রতিবছর ইকামা নবায়নে ৭ হাজার সৌদি রিয়াল খরচ হয়। আর চালকের ভিসায় লাগে মাত্র ৬০০ রিয়েল।

সংকটের পেছনে যারা

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ সূত্র বলছে, চালকের লাইসেন্স দেওয়ার এই সংকটের পেছনে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ পাওয়ার প্রতিযোগিতা এবং এর ফলে দরপত্র বাতিল করার ঘটনা দায়ী। এই দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টানাটানিতে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দপ্তরও। এর ফলে ঠিকাদার নিয়োগে সময়ক্ষেপণ হয়।

বর্তমানে চালকের লাইসেন্স প্রিন্টের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি। চলতি মাসের ২২ তারিখ তাদের সঙ্গে বিআরটিএর চুক্তি শেষ হচ্ছে। টাইগার আইটির প্রকল্প পরিচালক এ বি এম মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী তিন বছরের মধ্যে প্রায় সব কার্ড দেওয়া হয়ে গেছে। এখন বিআরটিএ যে কটি লাইসেন্স প্রিন্ট দিতে বলে, আমরা সে কটি প্রিন্ট করে দিই। এর বাইরে আমাদের কিছু করার নেই।’

টাইগার আইটির সঙ্গে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৩ জুন যে চুক্তি হয়, তাতে পাঁচ বছরে ১৫ লাখ স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স দেওয়ার কথা। তবে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে সোয়া ১৪ লাখ লাইসেন্স সরবরাহ করতে হয়। এরপর কার্ড সরবরাহ কমে যায়। পরবর্তী ২০ মাসে মাত্র ৪৪ হাজার কার্ড বিতরণ করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী তাদের হাতে কার্ড আছে আর ৩০ হাজার।

কার্ড শেষ হয়ে আসার পর বিআরটিএর সামনে দুটি বিকল্প ছিল। চুক্তির বাকি সময় বাড়তি টাকা অনুমোদন করে টাইগার আইটিকে দিয়েই লাইসেন্স সরবরাহ করা। অথবা নতুন করে দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদার নিয়োগ করা।

এর মধ্যে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) স্মার্ট কার্ড মুদ্রণসংক্রান্ত প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে ওবারথুর ও টাইগার আইটিকে সাড়ে ৯ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করে বিশ্বব্যাংক। এ পরিস্থিতিতে টাইগার আইটির সঙ্গে বাড়তি কার্ডের জন্য আর চুক্তি করেনি বিআরটিএ। এরপর ৩৫ লাখ স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স সরবরাহের জন্য ২০১৯ সালের ১০ জুন নতুন দরপত্র আহ্বান করে তারা। দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন ও কয়েক দফা দরপত্র জমা দেওয়ার সময় বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তিনটি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। এগুলো হচ্ছে ফ্রান্সের সেল্প কার্ডস সলিউশন, ভারতের মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স এবং মালয়েশিয়ার পার্সিতাকান ক্যাসেলামাতান ন্যাসিওনাল। ফ্রান্সের কোম্পানি এজেন্ট করে আইবিসিএস-প্রাইম্যাক্স সফটওয়্যার লিমিটেডকে। টাইগার আইটি কালো তালিকাভুক্ত হওয়ায় তারা সরাসরি অংশ নিতে পারেনি। তবে আইবিসিএস-প্রাইম্যাক্সের সঙ্গে ভেতরে-ভেতরে তাদের একটা সমঝোতা হয় বলে একটি সূত্র জানায়।

অন্যদিকে মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের এজেন্ট হয় সিএনএসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান লজিক ফোরাম। গত এক দশকে বিআরটিএর গ্রাহকদের নানা সেবা দিতে যেসব দরপত্র আহ্বান করে, এর সব কাজই পায় সিএনএস।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, সর্বনিম্ন দরদাতা হয় সেল্প সলিউশন (আইবিসিএস-প্রাইম্যাক্স)। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয় মাদ্রাজ প্রিন্টার্স (লজিক ফোরাম)। পার্সিতাকান ক্যাসেলামাতান ন্যাসিওনাল তৃতীয় হয়।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দরপত্র মূল্যায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে মাদ্রাজ প্রিন্টার্স বিআরটিএ ও সড়ক মন্ত্রণালয়ে তিন দফা অভিযোগ করে জানায়, সর্বনিম্ন দরদাতা সেল্প সলিউশনের আইএসও সনদ মেয়াদোত্তীর্ণ। আরও কিছু দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে তারা। তাদের অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে ওই দরপত্র বাতিল করে দেয় বিআরটিএ।

দ্বিতীয় দফায় একই প্রতিযোগী

গত বছরের ২০ জানুয়ারিতে আহ্বান করা হয় দ্বিতীয় দফা দরপত্র। লাইসেন্সের সংখ্যা করা হয় ৪০ লাখ। সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পায় আগের সেই তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই। এবার সর্বনিম্ন দরদাতা হয় মাদ্রাজ প্রিন্টার্স। তারা ১২০ কোটি টাকায় কাজ পায়। প্রতিটি স্মার্ট কার্ডের দাম ৩০০ টাকা ৬৬ পয়সা। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা সেল্প সলিউশন, ১৩২ কোটি টাকা। তাদের প্রতিটি কার্ডের দর ছিল ৩৩১ টাকা ১৫ পয়সা। পার্সিতাকান ক্যাসেলামাতান ন্যাসিওনালকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। মালয়েশিয়ান এ কোম্পানি মূলত মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের ডামি হিসেবে অংশ নেয় বলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে আলোচনা আছে।

গত বছরের ২৯ জুলাই মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের সঙ্গে চুক্তি সই করে বিআরটিএ। কাজ শুরুর চিঠি পায় সেপ্টেম্বরে। তিন মাসের মধ্যে লাইসেন্স সরবরাহের কথা তাদের। ডিসেম্বরে সেই সময় পেরিয়েছে। কিন্তু এখনো কার্ড সরবরাহ করছে না।

সড়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দরপত্রে দুই দফা কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের শর্ত দেওয়া হয়। ঠিকাদারকে দুটি মাইক্রোবাস ও একটি ডাবল কেবিন পিকআপ সরবরাহের কথা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে পিকআপের যাবতীয় খরচ পাঁচ বছর ঠিকাদারকে বহন করার শর্ত দেওয়া হয়। অথচ সরকার প্রকল্পের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ ও গাড়ি কেনা—দুটিতেই নিরুৎসাহিত করছে।

লাইসেন্স সরবরাহের চুক্তিতে মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের হয়ে লজিক ফোরামের এবং বিআরটিএর তিনজন করে ছয়জন সই করেছেন। এর মধ্যে ছিলেন লজিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এম তারিকুল হক। লাইসেন্স সরবরাহের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ৩০ মে প্রথম আলোকে বলেন, লাইসেন্স কবে পাওয়া যাবে, প্রস্তুতি কতটুকু—এসব বিষয়ে তিনি বলতে পারবেন না। তাঁরা শুধু প্রশাসনিক বিষয়গুলো দেখেন। মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। একই দিন মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের বক্তব্য জানতে ই-মেইল করলে এখনো জবাব পাওয়া যায়নি।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, দরপত্র প্রক্রিয়ায় মাদ্রাজ প্রিন্টার্স ও লজিক ফোরামের হয়ে বিভিন্ন বৈঠকে ও দর-কষাকষিতে উপস্থিত থাকতেন সিএনএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুনির উজ জামান চৌধুরীর শ্যালক মোস্তাক আহমেদ (লিটন)। আরও থাকতেন সিএনএসের এমডির ভাগনে, যিনি নিজেকে শুধু সালমান জিতু বলে পরিচয় দেন। সালমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি শুধু ডেভেলপমেন্ট (উন্নয়ন) বিষয় দেখেন। অন্য কিছু জানেন না।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, চলতি মাস থেকে স্বাভাবিকভাবে লাইসেন্স দেওয়া শুরু হবে। করোনার কারণে নতুন ঠিকাদারের লাইসেন্স সরবরাহে দেরি হচ্ছে। দুই ঠিকাদারের প্রতিযোগিতার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমার ধারণা নেই। প্রক্রিয়াগত কিছু সমস্যার কারণে ঠিকাদার নিয়োগে দেরি হয়েছে।’

গত ৩০ মে বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের লাইসেন্স সরবরাহের কাউন্টারের সামনে দুই শতাধিক লাইসেন্স প্রার্থীকে লাইনে দেখা যায়। নির্ধারিত তারিখে এসেও তাঁদের কেউ লাইসেন্স পাননি। সবাইকে আগামী বছরের জানুয়ারিতে আসতে বলা হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে লাইসেন্স পেতে দুই সপ্তাহ থেকে এক মাস সময় লাগত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত, এটা বিআরটিএর প্রশাসনিক ব্যর্থতা। তাই বিপুল মানুষের হয়রানি, ক্ষতির দায় তাদের নিতে হবে। এর বাইরে সরকারি কেনাকেটা–ঠিকাদার নিয়োগের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ও আছে। ফলে এতে যোগসাজশের মাধ্যমে দুর্নীতির আশঙ্কা থেকে যায়। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার চেষ্টার কারণে এভাবে মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা দরকার।