লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন

প্রতীকী ছবিছবি: রয়টার্স

অনেক বেসরকারি হাসপাতাল আবেদন করে বছরের পর বছর বসে আছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ধরনা দিচ্ছে, কিন্তু লাইসেন্স নবায়ন হচ্ছে না। হাসপাতালের উদ্যোক্তারা বলছেন, আবেদনপ্রক্রিয়া বেশ জটিল এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক দক্ষতায় ঘাটতি আছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অভিযোগ করে আসছে, অসংখ্য হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্স ছাড়াই চলছে।

এ পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ চিকিৎসাসেবা নিয়ে সমালোচনার মুখে মন্ত্রণালয় তড়িঘড়ি করে এক মাস সময় দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ২৩ আগস্টের মধ্যে লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করতে বলেছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে সব হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক মালিক সমিতির সভাপতি মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া। কারণ, লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিয়োজিত কর্মকর্তা আছেন মাত্র নয়জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ফরিদউদ্দীন মিয়া প্রথম আলোকে জানান, লাইসেন্স নবায়নের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১১ হাজার ৭৭৩টি আবেদন অনলাইনে জমা আছে। এগুলোর মধ্যে ৪ হাজার ৫১৬টি হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে। বাকি আবেদনগুলো এখনো প্রক্রিয়াধীন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। ২০১৮ সালের পর এই হিসাব হালনাগাদ হয়নি।

তবে লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়াকে জটিল বলছেন অনেকেই। এ প্রক্রিয়াকে ‌‌‘চাঁদাবাজি’ বলে মন্তব্য করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, নবায়নের প্রয়োজন আছে, কিন্তু লাইসেন্সের জন্য যেভাবে দৌড়াতে হয়, ঘাটে ঘাটে পয়সা দিতে হয়, তা চাঁদাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। তিনি বলেন, ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের লাইসেন্স নবায়নের জন্য তিন বছর আগে আবেদন করা হয়েছে। চাঁদা দিয়েছি ১০ লাখ। তারা যে ফি নির্ধারণ করেছে, সেটাও ডোনেশনের (অনুদান) মতো। এত টাকা বড় ব্যবসায়ী ছাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। মোট কথা, স্বাস্থ্য খাতের কোথাও টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। বিদ্যমান নিয়ম ও প্রক্রিয়া সংশোধন না করলে এভাবেই নবায়ন ছাড়া হাসপাতাল চলবে। আর আমাদের চাঁদা দিয়ে যেতে হবে।’

বেসরকারি বড় বড় হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন না করা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গত মাসে হাইকোর্ট বলেছেন, বারডেমের মতো বেশ কিছু বড় বড় হাসপাতালেরও লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। তাহলে এখন এসব কীভাবে চলবে। এ প্রশ্নের জবাব কী জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বারডেম লাইসেন্সের জন্য অনেক আগেই আবেদন করেছে। এখন সমস্যা যেটা হয়েছে মালিক নিয়ে। তাদের অনলাইনে আবেদনে মালিকের নাম লিখতে বলা হয়েছে। এখন বারডেমের মালিক তো জনগণ। তো আমরা কার নাম লিখব। আর নাম না লেখার কারণে আবেদন জমা হয় না। এ ছাড়া বারডেমের ভবন তো তৈরি করেছে পিডব্লিউডি। তারা পরিবেশের ছাড়পত্র নেয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বারডেমের লাইসেন্সের দরকার কী। এটা তো সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। সরকারের অনুদানেই এটা চলে।’

আগের পদ্ধতি বাদ দিয়ে ২০১৮ সালে হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়নের জন্য বিভিন্ন শর্ত ও কাগজপত্র জমা দেওয়ার নিয়ম করে অনলাইনে আবেদনের পদ্ধতি চালু হয়। একটি শর্ত পূরণ না করলেই অনলাইনে আবেদন গৃহীত হয় না। ফলে লাইসেন্স নবায়নে জট লেগে গেছে। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ২৩ আগস্টের মধ্যে আবেদন না করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যসচিব দুই রকম বক্তব্য দিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন। এক মাসের মধ্যে লাইসেন্স নবায়ন সম্পন্ন করতে হবে, তা যেভাবেই হোক। কিন্তু সচিব বলেছেন, আবেদন করতে হবে ২৩ আগস্টের মধ্যে। তাহলে কোনটা ঠিক? জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে যা বলেছি, সেটাই ঠিক ধরে নিতে হবে। এটাই আমার নির্দেশনা।’

নবায়ন ফি কত

আগে নবায়নের জন্য বার্ষিক ফি ছিল পাঁচ হাজার টাকা। ২০০৮ সালে অনলাইনে আবেদন জমা দেওয়ার পদ্ধতি চালু করা হয়। আর তখনই বার্ষিক ফি বাড়িয়ে ন্যূনতম ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় আগে যেকোনো শয্যার হাসপাতালের নবায়ন ফি ছিল পাঁচ হাজার টাকা। পুনর্নির্ধারিত ফি হলো ১০ থেকে ৫০ শয্যার জন্য ৫০ হাজার টাকা; ৫১ থেকে ১০০ শয্যা ১ লাখ; ১০১ থেকে ২৪৯ দেড় লাখ এবং ২৫০ শয্যার জন্য ২ লাখ টাকা। জেলা পর্যায়ে ন্যূনতম ৪০ হাজার ও সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা এবং উপজেলা পর্যায়ে সর্বনিম্ন ২৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা ফি নির্ধারণ করা হচ্ছে। ২৫০ শয্যার বেশি হাসপাতালের জন্য আরও বেশি। ভ্যাট যুক্ত হলে এই ফি আরও বেশি হবে।

আবেদন ফরম পূরণে জটিলতা

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মূলত আবেদনের ফরম পূরণ করতে গিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। আবেদন যদি সঠিকভাবে পূরণ না করে, যে কাগজপত্র চাওয়া হয়, তা না দেওয়া হয় এবং যাচাই-বাছাইয়ের সময় যদি কোনো ভুল তথ্য ধরা পড়ে, তাহলে আবেদন গ্রহণ করা হয় না। একটি হাসপাতালের লাইসেন্স বা নবায়নের জন্য যেসব তথ্য চাওয়া হয়, তা পূরণ করতে গিয়েও বিড়ম্বনায় পড়েন হাসপাতালের মালিকেরা। চিকিৎসক বা নার্স যাঁদের নাম আবেদনে দেওয়া হয়, তাঁদের নাম যদি অন্য কোনো আবেদনে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা গ্রহণ করা হয় না। চিকিৎসকদের নিবন্ধন নম্বর হালনাগাদ হতে হয়। দেখা যায় এক চিকিৎসক ১০ বছর আগে নিবন্ধন করেছেন, কিন্তু নবায়ন করেননি। সেই আবেদন গ্রহণ করা হয় না। বেশির ভাগ হাসপাতাল পরিবেশ বা মাদকের ছাড়পত্র দিতে পারে না।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বী প্রথম আলোকে বলেন, প্রক্রিয়াটি অনেক কঠিন। পরিবেশ ও মাদকের ছাড়পত্র পেতে বছর লেগে যায়। প্রতিবছর নবায়ন না করে তিন বছর পরপর করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

খুলনার সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদ বলেন, ‘আমাদের কাজ শুধু পরিদর্শন করে রিপোর্ট দেওয়া। নবায়নের কাজটি জেলা থেকেও করা যেতে পারে। তাহলে প্রক্রিয়াটি দ্রুততর হবে।’

বছরের পর বছর নবায়নের জন্য অপেক্ষা

একাধিক হাসপাতালের মালিক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়া ২০১৮ সাল থেকে বেশ জটিল করা হয়েছে। অনলাইনে আবেদনের যে নিয়ম করা হয়েছে, তা পূরণ করতে গিয়ে অনেক সময়ক্ষেপণ হয়। একাধিক ছাড়পত্র জমা দিতে বলা হয় নবায়নের জন্য, যা সংগ্রহ করতেই এক বছর লেগে যায়। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে জমা দেওয়া হলেও দেড় বছরেও কোনো কর্মকর্তা হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন না। এখন কেউ যদি ২০১৭ সালে আবেদন করে এবং তার লাইসেন্স যদি নবায়ন না হয়, তাহলে বছরের পর বছর এটা এভাবেই পড়ে থাকে। কিন্তু প্রতিবছর নবায়ন ফি ঠিকই ব্যাংকে জমা দিতে হয়।

জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সামিউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয় যে সময় বেঁধে দিয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই নবায়ন সম্পন্ন হবে না। তিনি জানান, তাঁর হাসপাতাল ২০১৯ সালের জুলাই মাসে আবেদন করেছে, ডিসেম্বরে আবেদন জমাও হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেননি। অধিদপ্তরে বারবার যোগাযোগ করা হয়েছে, চিঠি দিয়ে তাগাদা দেওয়া হয়েছে, কোনো সাড়া নেই।

লাইসেন্স নবায়নে যা প্রয়োজন

লাইসেন্স পেতে হলে হাসপাতালের মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্র, হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন (নতুন প্রতিষ্ঠান) বা আয়কর প্রত্যয়নপত্র (পুরোনো প্রতিষ্ঠান), ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নম্বর, পরিবেশ ছাড়পত্র, মাদকের ছাড়পত্র, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ক্ষতিকর ও অক্ষতিকর) চুক্তিপত্র ও চালানের স্ক্যান কপি অনলাইনে জমা দিতে হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তার হাসপাতাল পরিদর্শনকালে এসব নিরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা, সেবা প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কর্তব্যরত চিকিৎসকের নাম ও কর্তব্যরত নার্সদের নাম-ঠিকানা, ছবি, বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন, বিশেষজ্ঞ সনদ, নিয়োগ ও যোগদান বা সম্মতিপত্র জমা দিতে হয়। সাহায্যকারীদের তালিকা, অস্ত্রোপচার ও যন্ত্রপাতির তালিকাও হাসপাতালের প্রধানের স্বাক্ষরসহ জমা দিতে হয়।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়া সহজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, হুট করে হাসপাতালগুলোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিত নয়। এখানে মানুষ চিকিৎসা নেয়। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।