লিমনের সব মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত

লিমন হোসেন
লিমন হোসেন

র‌্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন হোসেনের বিরুদ্ধে করা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সব মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আজ মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর টেলিফোনে প্রথম আলো ডটকমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টেলিফোনে বলেন, ‘আমরা লিমনের মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লিমনের বয়স মাত্র ১৬ বছর। আমরা চাই সে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে যাক।’ সেই বিবেচনা থেকেই মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই চাচ্ছিলাম মামলা প্রত্যাহার করা হোক। কিন্তু কোনো এক কারণে বিষয়টি এগোচ্ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, তাঁরা মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়েছেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া লিমনকে বিষয়টি জানানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। জানা গেছে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা লিমনকে জানিয়েছেন।
২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে র‌্যাবের গুলিতে আহত হন লিমন। এ কারণে ওই বছর তিনি আর এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেননি। লিমনের অভিযোগ, বাড়ির পাশের মাঠ থেকে গরু আনতে গেলে র‌্যাবের সদস্যরা তাঁকে ধরে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেন। পরে গ্রামবাসী চাঁদা তুলে তাঁর চিকিৎসার খরচ চালান। একপর্যায়ে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে লিমনকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকেরা লিমনের জীবন বাঁচাতে তাঁর বাম পা ঊরুর নিচ থেকে কেটে ফেলেন।
এ ঘটনার পর বরিশালে র‌্যাব-৮-এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) লুৎফর রহমান বাদী হয়ে লিমনসহ আটজনের নামে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা করেন। একটি অস্ত্র আইনে, অপরটি সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে। মামলা দুটিতে লিমনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।
অন্যদিকে র‌্যাবের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে লিমনের মায়ের করা মামলা পুলিশ নেয়নি। পরে আদালতের নির্দেশে পুলিশ মামলাটি নেয়। কিন্তু পরে মামলাটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে শেষ করে দিয়েছে পুলিশ। এ চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করলে সেটাও খারিজ করে দেন ঝালকাঠির ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে জজ আদালতে রিভিশন দায়ের করেছেন হেনোয়ারা বেগম, যা এখনো চলছে।
লিমনের এ ঘটনা নিয়ে সারা দেশে আলোচনা, সমালোচনার ঝড় ওঠে। গণমাধ্যমগুলোও বিষয়টি নিয়ে গুরত্বসহকারে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশ করে। সর্বশেষ গত ৩০ মে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়্যারম্যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি অনানুষ্ঠানিক চিঠি (ডিও লেটার) লেখেন। ১৩ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে এ চিঠি পৌঁছে। ওই চিঠিতে লিমনের বিরুদ্ধে র‌্যাবের করা দুটি মামলা প্রত্যাহারের দাবি করা হয়। তাতে তিনি মন্ত্রীকে এ-ও লিখেন যে ‘আপনার সাথে ব্যক্তিগত আলাপের প্রেক্ষিতে আপনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’ চিঠিটি নথিভুক্ত করার জন্য ২০ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। এরপরে গত ২৩ জুন লিমন এবং তাঁর মা হেনোয়ারা বেগম ও বাবা তোফাজ্জেল হোসেনকে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তাঁর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে এ ব্যাপারে কথা বলেন। এ সময় তিনি র‌্যাবের করা মামলা প্রত্যাহারের স্বার্থে র‌্যাবের বিরুদ্ধে লিমনের মায়ের করা মামলা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করেন। জানতে চাইলে মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, লিমনের বিরুদ্ধে করা মামলা দুটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক বিধায় মানবাধিকার কমিশন প্রথম থেকেই তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে। একাধিকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সুপারিশও করা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে গুলিবর্ষণকারী র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে লিমনের মায়ের মামলা প্রত্যাহার করতে হবে কি না—এ প্রশ্নে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিষয়টি আসলে বিনিময় নয়, তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ ধরনের কথা আসতে পারে।’ মানবাধিকার কমিশন এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করছে কি না, জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, ‘মধ্যস্থতা করা মানবাধিকার কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত। এটা করতে পারলে তা অবশ্যই কমিশনের সফলতা বলে বিবেচিত হবে।’