দীনহীন ও শেখ ভানু
লোকসংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্রেরা
তাঁর রচিত অনেক গানই এখনো মানুষের মুখে মুখে। তবে এই উজ্জ্বল দুই নক্ষত্রের কিছু গান সংরক্ষণ করা গেলেও অধিকাংশই হারিয়ে গেছে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে।
‘আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম, তুমার সনে, একালা পাইয়াছি তরে, এই নিগুর বনে’ আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই গান লিখে গেছেন লোককবি দীনহীন ওরফে সৈয়দ আব্দুন নূর হোছেনী চিশতি। তাঁর এ গান এখনো ঝড় তোলে মানুষের মনে। হবিগঞ্জের এই কৃতী সন্তান এমন হাজারো মরমি ও জারিগান লিখে গেছেন।
দীনহীনের মতোই হবিগঞ্জের আরেক সাধক শেখ ভানু শাহ সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলার লোকসংগীতকে। ‘নিশিতে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা’র মতো তাঁর রচিত অনেক গানই এখনো মানুষের মুখে মুখে। তবে এই উজ্জ্বল দুই নক্ষত্রের কিছু গান সংরক্ষণ করা গেলেও অধিকাংশই হারিয়ে গেছে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে।
হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাহান আরা খাতুন বলেন, হবিগঞ্জকে মরমি সাধকদের রাজধানী বলা যায়। কারণ, এখানে দীনহীনসহ অসংখ্য মরমি কবি জন্মগ্রহণ করেছেন। দীনহীন হচ্ছেন তাঁদের মধ্যে এক নক্ষত্র। বর্তমানে আমাদের যে দুঃসময় চলছে, এ সময় দীনহীনের মতো মানুষের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তাই তাঁর রচনাসমগ্র সংরক্ষণ করা জাতীয় কর্তব্য।
হবিগঞ্জের বাহুবল ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হারুনুর রশিদ বলেন, ‘কথাকবি শেখ ভানু শাহ আমাদের লোকসাহিত্যে অনন্য অবদান রেখে গেছেন। তাঁর গান বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। শেখ ভানুর মরমি পুঁথিগুলো আমাদের পুঁথিসাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর অবদানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সরকারের উচিত শেখ ভানু শাহর গ্রামে একটি লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র চালু করা।’
শেখ ভানু শাহ ১৮৪৯ সালে লাখাই উপজেলার ভাদিকারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সংসারের হাল ধরতে মাত্র ১০ বছর বয়সে ফেরি করে ফলের ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসায়ে সফলতার পর শুরু করেন ধানের ব্যবসা। ভাটি অঞ্চল থেকে ধান সংগ্রহ করে দেশের নানা স্থানে বিক্রি করতেন। একবার ব্যবসায়িক কাজে নৌপথে ভৈরব থেকে আসার পথে নদীতে একটি মরদেহ ভেসে আসতে দেখেন। লাশের ওপর কিছু কাক বসে লাশের চোখের অংশ ঠুকরে খাচ্ছে। মানবদেহের এমন করুণ দৃশ্য দেখে তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তাঁর সফরসঙ্গী ভাগনে সোনা মিয়াকে সবকিছু বুঝিয়ে তিনি নদীতে ঝাঁপ দেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাঁকে পাওয়া যায়নি। এর কিছুদিন পর বামৈ বাজারের কাছে খালি গায়ে চুপ করে বসা থাকা অবস্থায় তাঁকে আবিষ্কার করেন এলাকাবাসী। তখন তিনি বাক্রুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। বেশ কিছু দিন কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। পুঁথি শেখ ভানু গ্রন্থে পাওয়া যায় এই বর্ণনা। এরপরই মূলত তিনি হয়ে ওঠেন আধ্যাত্মিক সাধক।
শেখ ভানু শাহর রচিত গ্রন্থ চেহেল অজুদ, আশরারুল এশক ও পুঁথি শেখ ভানু উল্লেখযোগ্য। সংরক্ষণের অভাবে এ বইগুলোর অস্তিত্ব এখন বিলীন। তবে আশার কথা হলো, শেখ ভানু–গবেষকদের প্রচেষ্টায় তাঁর রচিত দুই শতাধিক আধ্যাত্মিক গান ও পুঁথি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। হারামণি ম্যাগাজিন ১৯৪২ সালে শেখ ভানুর অনেকগুলো গান অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৩৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির উদ্যোগে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে বাংলাদেশের মরমি কবিদের মধ্যে চারজনকে দার্শনিক হিসেবে ভূষিত করা হয়। সেই চারজন হলেন লালন শাহ, শেখ ভানু শাহ, শেখ মদন শাহ ও হাসন রাজা।
শেখ ভানুর ভক্তদের তথ্যমতে, তিনি নিজ ঘরের অদূরে একটি বৈঠকি ঘর নির্মাণ করেন। সেখানেই প্রতিদিন এশার নামাজের পর মধ্যরাত পর্যন্ত স্রষ্টার বন্দনায় আধ্যাত্মিক গান গাইতেন, দরুদ পড়তেন ও জিকির করতেন। তখন ধীরে ধীরে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে শেখ ভানুর ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অধিকাংশ আধ্যাত্মিক গান ও পুঁথি তিনি রাতে রচনা করতেন। এ আধ্যাত্মিক গান ও পুঁথিগুলো ভক্তদের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে তাঁর বেশ কিছু আধ্যাত্মিক গান বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। শেখ ভানুর জীবন নিয়ে লেখা সুফি দার্শনিক কবি শেখ ভানু বইয়ে বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে।
শেখ ভানু শাহ বাংলা সনের ৩ কার্তিক ১৩২৬ বঙ্গাব্দ (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ) মৃত্যুবরণ করেন।
শেখ ভানুর খানকায় সংরক্ষিত আছে তাঁর ব্যবহৃত একটি সুদৃশ্য পালং, একটি ছড়ি, একটি বড় পিতলের পাতিল, একটি লোহার সিন্দুক ইত্যাদি। দেশ-বিদেশ থেকে অনেক ভক্ত তাঁর সম্পর্কে জানতে এখানে আসেন বলে জানান খানকার খাদেম সাইদুল মিয়া।
লাখাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুসিকান্ত হাজড়া প্রথম আলোকে বলেন, শেখ ভানু শাহের সমাধি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেকটা অস্তিত্ব হারাতে বসেছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁর কবরটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাঁর বাড়িতে একটি পাঠাগার নির্মাণের পরিকল্পনা আছে।
দীনহীন সম্পর্কে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলে গেছেন, মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে পদাবলি সাহিত্যের পাশাপাশি সুফি কবিদের মরমিসংগীত এক বিশেষ স্থান দখল করে রাখে। দীনহীন ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
দীনহীন রচনাবলি প্রথম খণ্ডে এই সাধক সম্পর্কে বলা হয়েছে, ছোটবেলা থেকেই দীনহীন ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর অতিশয় মধুর ও আকর্ষণীয় ছিল। তিনি শৈশবেই আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেন। কাব্যগীতি ও আধ্যাত্মবাদের সন্ধান করতে গিয়ে হারিয়ে যেতেন রহস্যের অতল গহ্বরে।
দীনহীনের জীবন ও কর্ম নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক বই প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামালের লেখা ছয় মরমী কবি (১৯৯৬), সিলেটের মরমী সাহিত্য (১৯৯৮) ও দীনহীন: ঐতিহ্য উত্তরাধিকার (২০০০); গবেষক ফজলুর রহমানের লেখা সিলেটের মরমী সঙ্গীত (১৯৯৩); সৈয়দ হাসান ইমাম হোসেনীর সম্পাদনায় দীনহীন রচনাবলি (১৯৯৭) উল্লেখযোগ্য। দীনহীনের আধ্যাত্মিক, মরমিসংগীত ও সুরের মূর্ছনায় আজও অগণিত ভক্তের আসর বিমোহিত হয়ে ওঠে।