‘শক্তিশালী দেশগুলোরই বেশি প্রাধান্য জাতিসংঘে’

জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছরের পূর্তিতে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে বক্তারা বলেছেন, শক্তিশালী কয়েকটি দেশ জাতিসংঘে প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে। সংস্থাটির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা প্রতিষ্ঠায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতিফলনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) ও জাতিসংঘ যৌথভাবে বুধবার এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে। বক্তারা জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁরা বলেন, অভিবাসীদের সুরক্ষার মত বিষয়গুলো বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এ বিষয়গুলো জাতিসংঘে অবহেলিত হচ্ছে।

দুই দিনব্যাপী এ ওয়েবিনারের বুধবার প্রথম দিনে উদ্বোধনী অধিবেশনের পাশাপাশি শান্তিরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার ও মানবিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে তিনটি আলাদা কর্ম অধিবেশনে আলোচনা করেন বক্তারা।

জাতিসংঘকে কয়েকটি বড় দেশের ক্লাব বলে মন্তব্য করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে জাতিসংঘ অনৈতিক ও অন্যায্য একটি সংস্থা হিসাবে পরিণত হয়েছে। বহু পাক্ষিক ব্যবস্থা ও দেশের সার্বভৌমত্বের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ। যে দেশ যত বেশি শক্তিশালী, সেই দেশ তত বেশি জাতিসংঘ নীতি লঙ্ঘন করে থাকে। জাতিসংঘ ছোট দেশগুলির সমস্যার সমাধানের ওপর গুরুত্ব দেয় না।

ছোট দেশগুলির দর্শন ও ইচ্ছার প্রতিফলন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ডকুমেন্টে নেই জানিয়ে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব যে মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে ওই মানদণ্ডে সারা বিশ্বে মানবাধিকারকে পরিমাপ করা হয়। সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই ব্যবস্থা দুর করা সম্ভব।

তবে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফ্যাবরিজিও হশচাইল্ড বলেন, জাতিসংঘ ঠিকমতো কাজ করছে। তবে অনেকে মনে করে এখন জাতিসংঘের প্রয়োজন রয়েছে মৌলিক সেবা প্রদান করার জন্য।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ার এম এ কাশেম বলেন, বর্তমান সমস্যা-সংকুল সময়ে জাতিসংঘ একমাত্র সংস্থা যা সব দেশকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে পারে।

অ্যাকশন এইডের এদেশীয় পরিচালক ফারাহ কবির বলেন, জাতিসংঘের গুরুত্ব নির্ভর করবে প্রতিটি দেশের জনগণ নিজের দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারে তার ওপর। তিনি কোভিড-১৯ নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এ বিষয়ে সঠিক তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব জাতিসংঘের।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নমিতা হালদার কোভিড-১৯-এর টিকা বণ্টনের বিষয়ে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততার ওপর জোর দেন।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের পরিচালক অধ্যাপক শেখ তৌফিক এম হক বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় সব দেশকে এক কাতারে শামিল করার দায়িত্ব জাতিসংঘের।

ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের (এনডিসি) কমান্ড্যান্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল শেখ মামুন খালেদ বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত।

নরওয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দূত মারিতা সোরহেইম-রেনসভিক বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীদের প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের কাছ অনেক কিছু শেখার আছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিংয়ের (বিপসট) প্রধান প্রশিক্ষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন দেশের মিশনে গিয়ে শান্তিরক্ষীদের স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। তাঁর মতে, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকা ও বেসামরিক লোকজনকে সুরক্ষা দিতে না পারাটা শান্তিরক্ষীদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ।
জাতিসংঘের সফলতা ও ব্যর্থতা মেনে নিয়ে নাহিদা সোবহান বলেন, জাতিসংঘ এখনো গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি সবচেয়ে বড় বহুপক্ষীয় সংস্থা যেখানে সব দেশ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলতে পারে। অভিবাসী বিষয়টি জাতিসংঘে অবহেলিত বিশেষ করে মহামারি সময়ে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অণু বিভাগের মহাপরিচালক সামিয়া আঞ্জুম বলেন, শান্তির পূর্বশর্ত হচ্ছে উন্নয়ন আর বাংলাদেশ এখানে সামনের সারিতে রয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান ররি মানগুভেন বলেন, প্রতিবেশী মিয়ানমারের সংকট সামাল দিতে গিয়ে বাংলাদেশকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেলাল মহিউদ্দিন। তাঁর মতে, জাতিসংঘের উচিত হবে মিয়ানমারের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ভাগ্যে কি ঘটছে তার ওপর নজর রাখা।

সিপিএসের সমন্বয়ক এম জসিম উদ্দিন বলেন, নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কেন যে ভূমিকা রাখছে না সেটা অনেককে অবাক করেছে।