
প্রায় ৩০ বছর আগে বিয়ে হয় মরিয়ম বেগমের। স্বামী পেশায় দরজি হলেও মরিয়ম সেলাইয়ের কাজ জানতেন না। সেই মরিয়ম এখন কুটিরশিল্পের প্রায় ১৬ ধরনের কাজে পটু। কোনোটা হাতে-কলমে শিখেছেন, আর কোনোটা দেখে দেখে। হাতের কাজ দিয়ে নিজের অবস্থা ফেরানোর পাশাপাশি সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে বদলে দিয়েছেন হাজারো জীবন।
মরিয়ম বেগমের বাড়ি কুড়িগ্রাম নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের আস্করনগর গ্রামে। শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা টিনের চালার নিচে অনেকে হাতের কাজ শিখছেন। কথা বলে জানা গেল, তাঁরা প্রায় সবাই দরিদ্র। তাঁদের কেউ বিধবা বা স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন, কয়েকজন শিক্ষার্থী। মরিয়ম বেগম নিজে ধরে ধরে তাঁদের কাজ দেখিয়ে দিচ্ছেন।
মরিয়ম জানান, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর ১৯৮৫ সালে তাঁর বিয়ে হয় দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। স্বামীর বাড়িতে অভাব শুনে বাবা তাঁকে (মরিয়ম) ফিরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি পালিয়ে স্বামীর বাড়িতে চলে আসেন। দেলোয়ারকে বলেন তাঁকে দরজির কাজ শিখেয়ে দিতে। কিন্তু দেলোয়ার রাজি হননি। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। লুকিয়ে দেখতেন কীভাবে কাজ করেন স্বামী। স্বামী বাইরে গেলে তিনি একাই চেষ্টা করতেন। এখন দরজির কাজের পাশাপাশি ব্লক-বাটিক, কারচুপির কাজ পারেন। শীতলপাটি, মোড়া, ব্যাগ, নকশিকাঁথা, ডালি, কাগজের ঠোঙা, পাপোশসহ নানা জিনিস তৈরি করতে পারেন অনায়াসে।
‘অভাব, শেখার ইচ্ছা আর জেদে বেশির ভাগ কাজ নিজে নিজে শিখেছি। একদিন খবর পেলাম নাগেশ্বরী উপজেলায় ব্লক-বাটিকের কাজ শেখাচ্ছে। আমিও শিখতে যাই কিন্তু নেয়নি। পরে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দেখি, শুনি ও লিখে নিই। টাকা জমিয়ে বাড়িতে কাপড়, রং ও সরঞ্জামাদি কিনে নিজে নিজে শিখে ফেলি। যাঁরা শিখিয়েছেন, তাঁরা এখন বলেন, “আপা, আপনি আমাদের চেয়ে সুন্দর কাজ করেন।”’ বলেন মরিয়ম।
বাড়ির হাঁস, মুরগি ও ছাগল বিক্রি করে প্রথমে সেলাই মেশিন কেনেন। তারপর কাপড় কিনে ব্লাউজ, পেটিকোট আর বাচ্চাদের জামা বানিয়ে গ্রামে বিক্রি করতেন। এগুলো ভালো মানের হওয়ায় পরে পাইকার এসে বাড়ি থেকে নিয়ে যেত। এভাবে কাজ করে এক বছরে ৪০ হাজার টাকা আয় করেন। ওই টাকায় ছয় শতক জমি বন্ধক নেন।
মরিয়ম বলেন, ‘আমাকে দেখে গ্রামের মহিলারা কাজ শিখতে চান। তাঁরা আমাকে কাজ শেখাতে বলেন। তখন চিন্তা করি, আমার মতো গ্রামে অনেকে কষ্টে থাকেন। তাঁদের কাজ শেখাব।’ কিন্তু কাজ যে শেখাবেন তার টাকা কই? তাই বাধ্য হয়ে ১০ হাজার টাকা ধার নেন। একটা নতুন ঘর তোলেন আর সরঞ্জাম কেনেন। প্রথমে গ্রামের গরিব ও বিধবা নারীদের ডেকে সেলাই শেখান। এতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। তখন দূর থেকে নারী-পুরুষ অনেকে কাজ শিখতে আসেন। মরিয়মের কাছে কাজ শিখতে আসা ইউনুস বলেন, তাঁরা ৩০ জন যুবক মরিয়ম আপার কাছে দরজির কাজ ও বুটিকের প্রশিক্ষণ নেন। পরে সবাই ঢাকার এক বুটিক কারখানায় কাজ শুরু করেন। বর্তমান তিনি (ইউনুস) মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করেন।
২০০৬ সালে বাড়ির আঙিনায় ‘আস্করনগর বানিয়াটারী মহিলা উন্নয়ন সমিতি’র কার্যক্রম শুরু করেন মরিয়ম। এ সমিতির মাধ্যমে শুরু হয় প্রশিক্ষণের কাজ। বর্তমানে এ সমিতিতে তিন শতাধিক নারী প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সাবানা খাতুন তাঁদের একজন। তাঁর স্বামী দিনমজুর। অল্প আয়ে দিন চলত না। সাবানা বলেন, ‘মরিয়ম বু ডাকি আনি কাম শেখায়। এখন বাড়িতে দরজির কাজ করি। ভালোই চলছি।’
নিজ এলাকার বাইরেও মরিয়ম হয়ে উঠেছেন পরিচিত নাম। কুড়িগ্রাম জেলার নয় উপজেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁকে ডেকে নিয়ে যায় কুটিরশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। কুড়িগ্রাম ছাড়াও কয়েকটি জেলার কয়েক হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি।
এলাকার কয়েকজন শারীরিক, বুদ্ধি ও বাক্প্রতিবন্ধী কিশোর-কিশোরীদেরও কাজ শেখান মরিয়ম। যারা কানে শুনতে পায় না, তাদের ইশারায় কাজ বুঝিয়ে দেন। তাদের তিনজন বর্তমানে একা একা কাজ করতে পারে।
মরিয়মের স্বপ্ন, দেশে কোনো বেকার থাকবে না। তিনি বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে বেকারত্ব দূর করতে চেষ্টা করতাম। এখন আমার সমিতিটিকে রেজিস্টার্ড (নিবন্ধন) করতে চাইছি।’ রামখানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সহিদার রহমান তালুকদার বলেন, শুধু আস্করনগর নয়, গোটা দেশের দরিদ্র নারীদের নিজের পায়ে দাঁড় করাতে সহযোগিতা করছেন তিনি। মরিয়ম দেশের রত্ন।