শনাক্ত হয়নি ৭৭ হাজার যক্ষ্মারোগী

করোনা মহামারির কারণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি।

মহামারির প্রভাব পড়েছে দেশের যক্ষ্মা পরিস্থিতির ওপর। করোনার কারণে গত বছর ৭৭ হাজারের বেশি যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

কেবল বিপুলসংখ্যক সাধারণ যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়নি, তা নয়, শনাক্তের বাইরে থেকে গেছে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগী। চিকিৎসার বাইরে থেকে এরা যক্ষ্মার সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।

করোনার কারণে অন্যান্য স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার মতো যক্ষ্মাসেবাও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট–এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়, যক্ষ্মার প্রকোপ বেশি এমন দেশগুলোতে আগামী পাঁচ বছরে মৃত্যু ২০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।

করোনা মহামারি এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এরই মধ্যে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কর্মকর্তারা দেশের যক্ষ্মা পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে বলছেন, করোনা ও যক্ষ্মার রোগী আলাদা করে শনাক্ত করা একটি কঠিন কাজ, কারণ দুটি রোগেরই কাশি, জ্বর ও শ্বাসকষ্টের মতো সাধারণ উপসর্গ দেখা দেয়। করোনা সংক্রমণের ভয়ে সাধারণ মানুষ ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবাকেন্দ্রে কম গেছেন। তবে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা তাঁরা হাতে নিয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, দেশে যক্ষ্মার রোগী ৩ লাখ ৬১ হাজার। যক্ষ্মা বছরে প্রায় ৩৯ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ। শনাক্ত হওয়া যক্ষ্মারোগীর ১৯ শতাংশ চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে যাঁরা চিকিৎসা পাচ্ছেন তাঁদের ৬ শতাংশের ক্ষেত্রে চিকিৎসা সফল হচ্ছে না। যক্ষ্মার প্রকোপ বেশি থাকা দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে।

বিশিষ্ট বক্ষব্যাধি চিকিৎসক ও বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অধ্যাপক আসিফ মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, সারা বিশ্বের জন্যই এটা বড় চ্যালেঞ্জ। যেসব দেশে সম্পদের স্বল্পতা আছে, সেসব দেশে সমস্যা আরও বড়। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতিমধ্যে সমাধানে কাজ শুরু করেছে। পেশাজীবী চিকিৎসকেরা সরকারকে সহায়তা দিচ্ছেন।

শনাক্তের বাইরে যাঁরা

দেশের জনসংখ্যা, রোগের প্রকোপ, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে বছরে রোগী শনাক্তের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। ২০২০ সালে ৩ লাখ ৭ হাজার ৬৭৪ জন নতুন যক্ষ্মারোগী শনাক্তের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার ৯০ জন রোগী। শনাক্ত হয়নি ৭৭ হাজার ৫৮৪ জন।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক সামিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সারা বছর দুই থেকে আড়াই কোটি মানুষ সাধারণ কাশি বা জ্বরে আক্রান্ত হয়। এদের একটি অংশ যক্ষ্মার রোগী। রোগের উপসর্গ দেখে বছরে প্রায় ২৭ লাখ মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এভাবেই রোগী শনাক্ত হয়। এরপর শনাক্ত রোগীর চিকিৎসা হয়।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে, শনাক্ত না হওয়া রোগীদের ৫০ শতাংশ ১৩টি জেলায়: বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, গাজীপুর, নরসিংদী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার। এই জেলাগুলোতে যক্ষ্মারোগী শনাক্তের সংখ্যা অন্য জেলার তুলনায় কম।

শুধু সাধারণ যক্ষ্মারোগী নয়, ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগীও শনাক্ত কম হয়েছে। পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ সেবন না করলে বা অনিয়মিত ওষুধ সেবন করলে বা নিম্নমানের ওষুধ সেবন করলে যক্ষ্মার জীবাণু ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠে। ২০২০ সালে এ ধরনের ১ হাজার ৮৯৮ জন রোগী শনাক্তের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা ছিল। কিন্তু শনাক্ত হয়েছে ৯৭৪ জন। শনাক্তের বাইরে থাকা রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না, তাঁরা সংক্রমণের ঝুঁকি হয়ে থাকছে।

করোনাভাইরাস
ছবি: রয়টার্স

করোনার প্রভাব

দেশে করোনা সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। মার্চ মাস থেকেই করোনার প্রভাব পড়ে যক্ষ্মা কর্মসূচিতে। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির পরিচালক আকরামুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা সময় দেশ লকডাউন অবস্থায় ছিল, মানুষের মধ্যে ভয় ছিল, সাধারণ মানুষ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ঘরের বাইরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। অনেক সেবাকেন্দ্র পরিপূর্ণ সেবা দিতে পারেনি।’ ব্র্যাক সরকারের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সহযোগী হিসেবে মাঠ পর্যায়ে প্রায় দুই দশক ধরে কাজ করছে।

কর্মসূচির কী কী সমস্যা হয়েছে, তার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে: কর্মসূচির আওতায় সব ধরনের প্রশিক্ষণ ও অবহিতকরণ স্থগিত ছিল, স্থানীয় লকডাউন ও যাতায়াত সমস্যার কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি অংশ কর্মস্থলে উপস্থিত হতে পারেননি, মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে যক্ষ্মারোগীদের চিকিৎসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে সরাসরি নজরদারিভিত্তিক চিকিৎসা (ডটস) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কোনো জেলায় পর্যবেক্ষণ সভা হয়নি। শহরে যেসব এনজিও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে সেসব এনজিওর কাজ লকডাউনের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক সামিউল ইসলাম বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে ৩২টি দল তৈরি করা হয়েছে। এসব দল দেশের প্রতিটি জেলা ঘুরে দেখেছে। দেশের সব যক্ষ্মা সেবাকেন্দ্র এখন পূর্ণ মাত্রায় চালু আছে। ২০২১ সালে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে আশা রাখি।