শরণার্থীদের নিরাপত্তার অধিকার জরুরি

২০২১ সালে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৮৯ দশমিক ৩ মিলিয়ন। এর মধ্যে শরণার্থী ২৭ দশমিক ১ মিলিয়ন।

কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে বসবাস করা রোহিঙ্গারা
ফাইল ছবি

গত এক দশকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রতিবছরই বেড়েছে। বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জোরালো প্রয়াস সত্ত্বেও শরণার্থীর সংখ্যা রেকর্ড ছুঁয়েছে। ২০২১ সালের শেষে যুদ্ধ, সহিংসতা, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৮৯ দশমিক ৩ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। এই সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি। আর এক দশক আগের তুলনায় সংখ্যাটি প্রায় দ্বিগুণ।

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) বার্ষিক প্রতিবেদন গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্টে এ মন্তব্য করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার জেনেভা থেকে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে দ্রুত ও বিপুল সংখ্যায় বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। এর পাশাপাশি আফ্রিকা থেকে আফগানিস্তানসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের পরিস্থিতির কারণে নাটকীয়ভাবে সংখ্যাটি এখন ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেছেন, গত এক দশকের মধ্যে প্রতিবছরই সংখ্যাটি বেড়েছে। অথচ এই সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানবিক বিপর্যয়, সংঘাত নিরসন কিংবা সংকট নিরসনের চেষ্টা চালিয়ে গেলেও সংখ্যা বাড়ার ভয়ানক প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকেনি।

আজ ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। বিশ্ব শরণার্থী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে শরণার্থীদের নিরাপত্তা চাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা। বাস্তুচ্যুত মানুষ যে বিশ্বাসের, যে প্রান্তের হোক না কেন, তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ হিসেবে তাকে মর্যাদা দিতে হবে। এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো রকম বৈষম্য করা চলবে না। কারণ, সুরক্ষা চাওয়া মানবাধিকার।

বিশ্বব্যাংককে উদ্ধৃত করে ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর অন্তত ২৩ দেশে নতুন করে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে কিংবা চলমান সংঘাতের মাত্রা বেড়েছে। এর ফলে অন্তত ৮৫০ মিলিয়ন মানুষ মাঝারি কিংবা প্রবল সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছে। অন্যদিকে, খাদ্যনিরাপত্তার ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। এতে করে অনেক ক্ষেত্রেই মানবিক সহায়তার সম্ভাবনাকে ফিকে করে দিয়েছে।

২০২১ সালে শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৭ মিলিয়ন। এর মধ্যে যে দেশগুলোয় সংখ্যা বেড়েছে উগান্ডা, চাদ ও সুদান তার অন্যতম। অতীতের মতো এবারও এসব শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে, যাদের সম্পদ ও সামর্থ্য সীমিত। রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে ৪ দশমিক ১ মিলিয়ন হয়েছে, অর্থাৎ সংখ্যা বৃদ্ধির হার ১১ শতাংশ।

গত বছর টানা ১৫ বারের মতো অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির ঘটনা অব্যাহত থাকায় সংখ্যাটি এখন ৫৩ দশমিক ২ মিলিয়ন। মিয়ানমারসহ বেশ কিছু দেশে এ ধরনের সংঘাত কিংবা সহিংসতায় সংখ্যাটি বেড়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে শরণার্থী ইস্যুটি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গিয়েছিল। বৈশ্বিক ওই সংকট শরণার্থী সমস্যাকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। তবে এটা ঠিক যে শরণার্থী ইস্যুটি আবার আলোচনায় ফিরলেও সব দেশের শরণার্থীর ক্ষেত্রে যে একই মনোযোগ ফিরেছে, এমনটা বলার সুযোগ নেই।
অধ্যাপক মো. শহীদুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের ফেলো

ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলছেন, নতুন করে লোকজনের শরণার্থী হয়ে পড়া এবং বিদ্যমান সংকট ঝুলে থাকার মতো দুর্বিষহ দৃশ্য দেখার সাক্ষী আমরা হচ্ছি। তা সত্ত্বেও বেশ কিছু দেশে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়া লোকজনের সমস্যা সমাধানে অনেককে একসঙ্গে কাজ করতেও দেখছি।

ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৮৯ দশমিক ৩ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে শরণার্থী, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ও ভেনেজুয়েলার শরণার্থী রয়েছে। এর মধ্যে শরণার্থী ২৭ দশমিক ১ মিলিয়ন, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ ৫৩ দশমিক ২ মিলিয়ন, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন এবং ভেনেজুয়েলার শরণার্থী ৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের ফেলো অধ্যাপক মো. শহীদুল হক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে শরণার্থী ইস্যুটি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গিয়েছিল। বৈশ্বিক ওই সংকট শরণার্থী সমস্যাকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। তবে এটা ঠিক যে শরণার্থী ইস্যুটি আবার আলোচনায় ফিরলেও সব দেশের শরণার্থীর ক্ষেত্রে যে একই মনোযোগ ফিরেছে, এমনটা বলার সুযোগ নেই।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বের দুই–তৃতীয়াংশের বেশি (৬৯ শতাংশ) শরণার্থী এসেছে পাঁচটি দেশ থেকে। দেশগুলো হচ্ছে সিরিয়া (৬ দশমিক ৮ মিলিয়ন), ভেনেজুয়েলা (৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন), আফগানিস্তান (২ দশমিক ৭ মিলিয়ন), দক্ষিন সুদান (২ দশমিক ৪ মিলিয়ন) ও মিয়ানমার (১ দশমিক ২ মিলিয়ন)।

গত বছরের শেষ পর্যন্ত যে ১০টি দেশ প্রতিবেশী দেশের লোকজনকে আশ্রয় দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে, ওই তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে সপ্তম স্থানে।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালের আগে থেকে অন্তত লাখ চারেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনাচৌকিতে জঙ্গি হামলাকে অজুহাত দেখিয়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এরপর থেকে পরের কয়েক মাসে বাংলাদেশে এসেছে আরও সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১২ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশে।

আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ায় মিয়ানমার নেপথ্যে চীনকে রেখে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের চুক্তি সই করেছিল। প্রত্যাবাসনের জন্য দুবার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেও তা শুরু করা যায়নি। এমনকি চীনের মধ্যস্থতায় দুই দেশ আলোচনা করেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারণ, মিয়ানমারের রাখাইনে যেমন অনুকূল পরিবেশ ফেরেনি, তেমনি রোহিঙ্গাদের মতামত ছাড়া প্রত্যাবাসন যে সম্ভব নয়, সেটি স্পষ্ট। উপরন্তু গত বছর মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে আরও ফিকে করে তুলেছে।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক মনে করেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে মিয়ানমারে গত বছরের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটির পরিস্থিতিতে নাটকীয় এক পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি বলেন, শুধু মিয়ানমারের শহরগুলোতে নয়, এখন সমগ্র দেশে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। লড়াইটা এখন আর মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বা বামারদের সঙ্গে সংখ্যালঘুদের মধ্যে সীমিত নয়।

সেনাবাহিনী এখন বামারদের বিরুদ্ধেও লড়াই করছে। ফলে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকার বা এনইউজি এখন অন্য একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই মধ্যে এনইউজি আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছে। ফলে মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতির বিষয়ে বাংলাদেশের সজাগ থেকে অবস্থান ঠিক করতে হবে।

পাশাপাশি রোহিঙ্গাদেরও আত্মস্থ করতে হবে যে মিয়ানমারে যে পরিবর্তন ঘটছে, তার সঙ্গে তাদের ভবিষ্যতের প্রসঙ্গটি জড়িয়ে আছে। ঢালাওভাবে সবকিছুকে প্রত্যাখ্যান করার মানে স্রোতের বাইরে চলে যাওয়া। কারণ মিয়ানমারে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক যে পরিবর্তন ঘটবে, তাতে এনইউজির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। আবার সেনাবাহিনী অতীতে যে প্রভাব রেখে এসেছে, তাতে একটা পরিবর্তন আসতে পারে।