শহরে প্রজাপতির ঝাঁক

কেউ তাদের বলে সৌভাগ্যের প্রতীক। আর গায়ে বসলে তো কথাই নেই। লোকে বলে বিয়েটা বুঝি এবার হয়েই যাবে। বাদামি রঙের দুটি পাখা নিয়ে ঘরে-বাইরে ওড়াউড়ি করছে তারা। প্রজাপতি। বেশ কিছুদিন থেকে রাজধানীর বাসাবাড়িতে প্রচুর সংখ্যায় একটি বিশেষ ধরনের প্রজাপতির দেখা মিলছে। তারা ঢুকে পড়ছে ঘরের মধ্যেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়া ও পরিবেশের পরিবর্তনের প্রভাবে শহরমুখী হয়েছে এই প্রজাপতির ঝাঁক। তবে এতে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান এম এ বাশার দীর্ঘদিন ধরে প্রজাপতি নিয়ে গবেষণা করছেন। গত সোমবার প্রাণিবিদ্যা বিভাগে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। লোকালয়ে হঠাৎ এত প্রজাপতির আগমনের কারণ সম্পর্কে বললেন, এসব প্রজাপতি শহরমুখী হয়েছে মূলত মৌসুম ও তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলে। শীতের দৈর্ঘ্য হওয়ার কথা চার মাস। কিন্তু এখন দুই মাসের বেশি শীত পড়ে না। তিনি বলেন, ‘এখন যে আবহাওয়া আমরা দেখছি, এটা শুরু হওয়ার কথা সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে। অথচ নভেম্বর প্রায় শেষ, শীত কিন্তু পড়ছে না। ফলে এসব প্রজাপতি বের হওয়ার সময় পাচ্ছে খুব কম।’ তিনি জানালেন, খুব বেশি শীত এবং খুব বেশি গরমে এরা থাকতে পারে না। এ জন্যই এরা এখন একসঙ্গে বের হয়ে লোকালয়ে ঘুরছে। ছায়াযুক্ত জায়গা বেছে নিচ্ছে। গাছের নিচে মরা বা পচা পাতায় এরা ঘুরে বেড়ায়। ঢাকায় ঝোপঝাড়, গাছপালার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এদের বিচরণের জায়গাও কমে আসছে। তাই এরা আশ্রয় নিচ্ছে বাড়িঘরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে প্রজাপতি ইদানীং লোকালয়ে দেখা যাচ্ছে, এগুলো ‘নিকুঞ্জ পরিবার’-এর (Satyridae Family) অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে এই প্রজাপতির ৩২ প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে। ফুলের কাছে এরা খুব কম যায়। ছায়া, স্যাঁতসেঁতে ও ঠান্ডা জায়গায় এরা বাস করে। বিশেষ করে সন্ধ্যায় ও ভোরে বাইরে বের হয়। পচনশীল বস্তু থেকে খাবার সংগ্রহ করে। ছত্রাক থেকে একধরনের মিষ্টিজাতীয় খাবার খায়। এসবের উপস্থিতি যেখানে আছে, সেখানে এই প্রজাপতি বেশি দেখা যায়। সন্ধ্যায় এবং ভোরে যখন আলো থাকে কিন্তু রোদের তেজ থাকে না, তখনই ছেলে ও মেয়ে প্রজাপতি মিলিত হয়। ডিম থেকে বংশবিস্তার। পাখায় আছে অক্ষিবিন্দুর মতো ফোঁটা। শীতে এদের সংখ্যা বাড়ে। পূর্ণবয়স্ক নিকুঞ্জ প্রজাতির প্রজাপতি ১০ থেকে ১৫ দিনের মতো বাঁচে। এরা খুবই সংবেদনশীল। একটানা বেশিক্ষণ উড়তে পারে না। যেখানে-সেখানে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ ওড়ার পর এদের খেতে হয়। লোকালয়ে খাবার না পেলে পড়ে গিয়ে মরে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বন্য প্রাণী ও জীববিজ্ঞানী আ ন ম আমিনুর রহমান জানান, ‘এই প্রজাতির প্রজাপতি বহু প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে আছে। বর্ষায় এরা সুপ্ত থাকে। হালকা শীতের সময় বেশি সক্রিয় থাকে। এ সময় আমাদের এখানে অনেক পরিযায়ী পাখি আসে। এসব প্রজাপতি পরিযায়ী পাখিদের প্রিয় খাদ্য। আবার মৃত্যুর হারও বেশি। ফলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অনিবার্য প্রয়োজনে বিপুল সংখ্যায় এই প্রজাপতি জন্মে থাকে। ঝোপঝাড় কমে যাওয়ায় এদের আবাসনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে অনেক সময় এরা শহরাঞ্চলে বা লোকালয়ে চলে আসে। এবার একটু বেশি সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে। তবে এতে উদ্বেগের কিছু নেই। বরং প্রজাপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশের জন্য ভালো লক্ষণ।’
রোগজীবাণু ছড়াচ্ছে কি না, এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা জানান, এরা ক্ষতিকর নয়। বরং উপকারী পতঙ্গ। দেশের পরিবেশ কোন দিকে যাচ্ছে তার আগাম আভাস পাওয়া যায় প্রজাপতির গতিবিধি দেখে। অধ্যাপক বাশার প্রজাপতি রক্ষণাবেক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর অভিমত, ঢাকায় পাঁচ-সাতটি প্রজাপতি পার্ক তৈরি করা উচিত। তাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এদের গুরুত্ব বুঝতে পারবে। পার্ক হলে এদের নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে আরও গবেষণা করা যাবে।