শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা চূড়ান্ত

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির অংশ হিসেবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা চূড়ান্ত করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হলেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রীয় কোনো তালিকা নেই। আবার তালিকা নির্ধারণের জন্য শহীদ বুদ্ধিজীবীর পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞাও নেই।

নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁরা শহীদ বুদ্ধিজীবী।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্র জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষকে সভাপতি করে বুধবার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা চূড়ান্ত করা হয়।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নির্ধারণে বাংলা একাডেমি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করেছিল। সেই কমিটির নির্ধারিত সংজ্ঞায় কয়েকটি পেশা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁরাই বুদ্ধিজীবী। কিন্তু নতুন সংজ্ঞায় অনেককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে তাঁদের অবদান রয়েছে।

শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, এই সংজ্ঞানুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করতে গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ জহিরকে প্রধান করে একটি উপকমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কমিটি ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ করবে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির জন্য গত বছরের ১৯ নভেম্বর একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্য তিনি (শাহরিয়ার কবির)। তালিকা প্রকাশের দিনক্ষণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ২৫ মার্চ একখণ্ড তালিকা প্রকাশ করব।’

এর আগে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীদের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল তাতে বলা হয়, ‘বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী।’

বুধবারের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সংজ্ঞা চূড়ান্ত করার পাশাপাশি বৈঠকে ডাকটিকিটে ডাক বিভাগের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ করা ১৫২ জন বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রাথমিকভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ১ হাজার ৭০ জনের তালিকা চায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটি। বাংলাদেশ ডকুমেন্ট, বাংলা একাডেমির বুদ্ধিজীবী কোষ, বাংলাপিডিয়া, ডাক বিভাগ ছাড়াও এর বাইরে আরও তালিকা আছে। ফলে তালিকা অনেক বড় হবে।

এসব মিলিয়ে তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। এ ছাড়া কিছু বেসরকারি উদ্যোগেও গবেষণা হয়েছে, সব কটি সংগ্রহে আনা হবে। শহর-গ্রামনির্বিশেষে সব জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজে প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তপন কান্তি ঘোষের সঙ্গে বুধবার সন্ধ্যায় তাঁর কার্যালয়ে আলাপকালে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২৫ মার্চ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকার প্রথম খণ্ড প্রকাশ করব বলে আশা রাখছি। আজ সংজ্ঞা চূড়ান্ত করেছি। এটাকে সামনে রেখেই তালিকা তৈরির কাজ শুরু হবে।’

প্রসঙ্গত, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটিতে গবেষক সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের, নিপসমের পরিচালক বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ এবং গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের গবেষক গাজী সালাউদ্দিন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ জহির (বীর প্রতীক)। এই কমিটি বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থ, পত্রিকার কাটিং, টিভি রিপোর্ট, অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করবে।