শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে এসপির যত অভিযোগ

শামীম ওসমান। ফাইল ছবি
শামীম ওসমান। ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একগুচ্ছ লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন অর রশীদ। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরাধীদের থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চাপ, পুলিশকে হুমকি, আচরণবিধি লঙ্ঘন করে দেহরক্ষীকে ছেলের সঙ্গে সংসদীয় এলাকার বাইরে পাঠানো এবং অন্যায়ভাবে ওয়াকিটকি ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গতিবিধি ও গোপন তথ্য জেনে নেওয়া ইত্যাদি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে আগেও পুলিশ প্রশাসন মৌখিকভাবে ও টেলিফোনে এ ধরনের অভিযোগ জানিয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান পুলিশকে সে সময় নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের আদেশ দেন।

জানতে চাইলে এসপি হারুন অর রশীদ বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যা যা করার দরকার, তা-ই আমরা করছি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মাদক, চাঁদাবাজি, জুয়া, অবৈধ বালু উত্তোলনসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। আর এতেই সাংসদ শামীম ওসমান ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। সাংসদ পুলিশ প্রশাসনকে হুমকি দিচ্ছেন, বাজে কথা বলছেন। তাই আমরা পুরো বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অবহিত করেছি।’

এসপির এসব অভিযোগকে শামীম ওসমান ‘ভিত্তিহীন’ বলে মন্তব্য করে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘দয়া করে আমাকে ওই লেভেলে নামাবেন না, ওনার মতো একজন এসপি আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ দেবে? তার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখা, তার সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’ তদবির করছেন বা হুমকি দিচ্ছেন কি না জানতে চাইলে শামীম ওসমান বলেন, ‘প্রমাণ দেখাক।’

নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও এলাকার মানুষের সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা প্রথম আলোকে জানান, শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে মামলা করার পরই পুলিশের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে শুরু করেন তিনি। তবে তাঁরা মনে করেন, এসব সাময়িক। হয়তো এসপি চাপ সৃষ্টি করে তাঁর অবস্থান বোঝাতে চাইছেন। কেউ কেউ আবার পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

বিএনপির নেতা–কর্মীরা প্রথম আলোকে বলেন, এই এসপি নারায়ণগঞ্জে আসার পরই বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে গায়েবি মামলা দিয়েছেন। এ কাজে শামীম ওসমানের সমর্থন ছিল। তাঁরা বিশ্বাস করেন না যে শামীম ওসমানের অপকর্মের বিরুদ্ধে এসপি হারুন প্রকৃত অর্থেই লড়ছেন।

অবশ্য শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তার সত্যতা রয়েছে বলে জানান নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ পাঠিয়ে এসপি হারুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। আজ পর্যন্ত শামীম ওসমানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো এসপি মুখে টুঁ শব্দটি করতে পারেননি। প্রশাসন সব সময় শামীম ওসমানের কবজায় ছিল। এ কারণে নতুন এসপি যা করছেন, তাতে সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে। তবে এসপি আসলেই মন থেকে কিছু করতে চাইছেন কি না, তা বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে করা অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি দেহরক্ষীর সঙ্গে থাকা ওয়াকিটকি সেট (বেতারযন্ত্র) ব্যবহারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গতিবিধি ও গোপন তথ্য জেনে যেতেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী সাংসদের দেহরক্ষী প্রাধিকারভুক্ত নন। তাঁর দেহরক্ষীর বেতারযন্ত্র ব্যবহারের সুযোগ নেই। তাই দেহরক্ষীর কাছ থেকে বেতারযন্ত্র প্রত্যাহার করে নেয় পুলিশ। কনস্টেবল মামুন ফকির কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া শামীম ওসমানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন না করে তাঁর ছেলে অয়ন ওসমানের সঙ্গে গত ১৪ থেকে ১৭ মার্চ অস্ত্র, গুলিসহ কক্সবাজারে অবস্থান করেন। এটি চাকরিবিধি আইনের পরিপন্থী। ওই সময় শামীম ওসমান দেহরক্ষী ছাড়া সংসদীয় এলাকায় ছিলেন। পরে ২৮ মার্চ মামুনকে প্রত্যাহার করে আরেকজনকে সাংসদের দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দেন এসপি। কিন্তু ১০ দিনেও নতুন দেহরক্ষী নেননি সাংসদ।
ওয়াকিটকির বিষয়ে শামীম ওসমান বলেন, ‘আমার কোনো ওয়াকিটকি নেই, ওটা ছিল দেহরক্ষীর। আর দেহরক্ষী আমার সন্তানদের সঙ্গে গিয়েছেন, সেখানে আমাদেরও যাওয়ার কথা ছিল। তাই ওকে আগে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। পরে একটি জরুরি সভা ডাকায় আমি যেতে পারিনি।’

শামীম ওসমান প্রভাব খাটিয়ে নারায়গঞ্জ সিটি করপোরেশন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীপন্থী ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। আইভী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসপিকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী মীর হোসেন ওরফে মিরুকে ২০ জানুয়ারি আটক করায় ক্ষুব্ধ হন শামীম ওসমান। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হন মীর। একপর্যায়ে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যান। তাঁর বিরুদ্ধে ফতুল্লা থানায় ২১টি মামলা রয়েছে। মীরকে গ্রেপ্তারের পর শামীম ওসমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এসপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। মন্ত্রী ঢাকার ডিআইজিকে ডেকে বিষয়টি জানতে চান। পরে শামীম ওসমান এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে বিচার দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। এ বিষয়ে শামীম ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন প্যারালাইজড লোকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ অযৌক্তিক।’

নারায়ণগঞ্জের জামতলা এলাকায় প্রবাসীর জমি দখলের চেষ্টা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে শামীম ওসমানের এক আত্মীয়ের বিরুদ্ধে মামলা করায় ক্ষুব্ধ হন শামীম ওসমান। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের ৫ নম্বর ঘাটসংলগ্ন এলাকায় ৪১ জন জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই জুয়াড়িদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে রাজুর নাম এসেছে, যিনি শামীম ওসমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ১ এপ্রিল রাতে সদর উপজেলার ফতুল্লার পাগলায় মেরি এন্ডারসনে বিপুল পরিমাণ মদ ও বিয়ার উদ্ধারের ঘটনায় শামীম ওসমানের শ্যালক ও নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক তানভীর আহমেদের নাম আসে। তবে শামীম ওসমানের দাবি, তাঁর শ্যালকের নাম নিয়ে যা বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয় বরং এসব কারণে তাঁর শ্যালকের সম্মান বাড়বে।

প্রশাসন সঠিকভাবে কাজ করছে বলে ওসমান পরিবারের বলয়ের লোকজনের সমস্যা হচ্ছে বলে মনে করেন নগরের চাষাঢ়া এলাকার ব্যবসায়ী শামীম হাসান। চাষাঢ়া শহীদ মিনার এলাকার বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা লোকমান হোসেন বলেন, ‘ওনার (এসপি) পদক্ষেপ তো ভালো লেগেছে। উনি কাউকে ছাড় দিতে চান না। প্রশাসন তো এমনই হওয়া উচিত। এখন দেখি সামনে কী হয়।’

পুলিশের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা উন্নয়ন চাই, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন চাই। কিন্তু পুলিশের এত জানান দেওয়ার দরকার নেই। যা করছে সব তো তদন্ত পর্যায়ে। তদন্ত শেষ হলেই মুখ খোলা উচিত।’ প্রশাসন বনাম সাংসদের এমন দ্বন্দ্ব তিনি আগে দেখেননি। সাংসদের এভাবে মুখোমুখি অবস্থান নেওয়া উচিত হয়নি বলে তিনি মনে করেন।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের কাছ থেকে অভিযোগগুলো পেয়েছি। এখন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে বর্তমান সরকার সব সময়ই ন্যায়ের পক্ষে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার নিজের কাজ করছে, করবে। এ ক্ষেত্রে কেউ বাধা দিলে আমরা মেনে নেব না। যারা অন্যায় করবে, সন্ত্রাসী কার্যক্রম করবে, চাঁদাবাজি করবে, মাদকের ব্যবসা করবে তাদের আইনের আওতায় এনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই পুলিশকে বলব তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে, কারও হুমকি-ধমকিতে থেমে যাওয়া চলবে না।’