বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগে পরিচালনা কমিটির পরিবর্তে জেলা শিক্ষক নিয়োগ কমিটি অথবা কমিশন গঠনে অনুশাসন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটা চূড়ান্ত হলে শিক্ষক নিয়োগে দেশের ৩০ হাজারেরও বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির ক্ষমতা খর্ব হবে।
এখন দেশের বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগ দেয় পরিচালনা কমিটি। এর মধ্যে কলেজের কমিটিকে বলা হয় গভর্নিং বডি ও বিদ্যালয়ের কমিটিকে বলা হয় ব্যবস্থাপনা কমিটি। এই কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগে দেশজুড়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগে ‘ডোনেশন’-এর নামে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি সমালোচিত ও নিন্দিত হলেও তা বন্ধ করতে পারছে না শিক্ষা প্রশাসন। সাধারণত পরিচালনা কমিটিগুলোতে স্থানীয় সাংসদ কিংবা তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরাই সভাপতি হয়ে থাকেন। একজন সাংসদ তাঁর নির্বাচনী এলাকার সর্বোচ্চ চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভাপতি হওয়ার সুযোগ পান।
বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, পরিচালনা কমিটির পরিবর্তে নিয়োগের বিষয়টি জেলা কমিটির কাছে গেলে তাতে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে না। তাঁরা কয়েক বছর ধরে সরকারি কর্মকমিশনের আদলে শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন পাওয়ার আগেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। গত মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ চিঠি দেওয়া হয়। পাশাপাশি এর অনুলিপি দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।
দেশে এখন এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৩০ হাজার। তবে মন্ত্রিপরিষদের চিঠিতে শুধু বিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও সমমানের মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির ধরনও প্রায় একই রকম।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানায়, গত ২৮ জুলাই জেলা প্রশাসক সম্মেলনে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতৃত্বে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। জেলা প্রশাসক সম্মেলনের ওই প্রস্তাবের আলোকে লেখা মন্ত্রিপরিষদের চিঠিতে বলা হয়, দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশে এ ধরনের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি শিক্ষক নিয়োগসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে থাকে। চিঠিতে আরও বলা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব হয় না। চিঠিতে সই করেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে এবং এ কাজের বেশ খানিকটা অগ্রগতি আছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীরা কেবল বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করতে পারেন। মন্ত্রণালয় চাইছে, এনটিআরসিএকে শক্তিশালী করে এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়ে উপজেলা, জেলা কিংবা জাতীয়ভাবে একটি চূড়ান্ত মেধাতালিকা করা হবে। এরপর মেধাতালিকার ক্রম অনুসারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। এর আগেই প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদের তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এ জন্য এনটিআরসিএ আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে।
তবে বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনগুলো পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আদলে শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠনের পক্ষে মত দিয়ে আসছে। তাঁদের মতে, শিক্ষক নিয়োগে চলমান দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধে এই কমিশন গঠনের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি এম এ আউয়াল সিদ্দিকী বলেন, শিক্ষক নিয়োগে জেলা কমিটি হলে বেপরোয়া দুর্নীতি বা টাকাপয়সার লেনদেন হয়তো কিছুটা কমবে, কিন্তু স্বজনপ্রীতি বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পছন্দ-অপছন্দ থেকেই যাবে। তাঁর মতে, জেলা কমিটি হলেও শিক্ষক নিয়োগে সাংসদ, জেলা প্রশাসক, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সরকারি দলের নেতাদের প্রভাব থেকে যাবে।