শিক্ষার আলো পাচ্ছে আশ্রয়শিবিরের প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা শিশু

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে থাকা প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা শিশু পড়াশোনা করছে। ইউনিসেফ ও বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় পরিচালিত ৩ হাজার ৪০০ শিক্ষাকেন্দ্রে তাদের পড়াশোনার কার্যক্রম চলছে। এসব শিশুরা বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, গণিত ও বর্মিজ ভাষা শিখছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের (আরআরআরসি) তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে আসে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ৩৪ হাজার। তাদের মধ্যে প্রায় চার লাখ শিশু পড়াশোনা করছে। ৩ হাজার ৪০০ শিক্ষাকেন্দ্রের মধ্যে ২ হাজার ৮০০টি শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে ইউনিসেফের সহায়তায়।

রোববার উখিয়ার মধুরছড়া বাজারে কথা হয় মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা ছালামতের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর দুই ছেলে কামরুল (১২) ও রফিক (১০) আশ্রয়শিবিরের একটি শিক্ষাকেন্দ্রে পড়ছে। বই, খাতা, কলম, ব্যাগ সবকিছু পাচ্ছে বিনা মূল্যে। মেয়ে শফিকা (৮) পড়ছে একটি মক্তবে, সেখানে পড়ানো হয় ধর্মীয় শিক্ষা।

আরআরআরসি কার্যালয়ের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, বাংলা ছাড়া রোহিঙ্গা শিশুদের মেধার বিকাশে ইংরেজি, গণিত ও বর্মিজ ভাষায় শিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে থাকা শিশুদেরও কেন্দ্রমুখী করার চেষ্টা চলছে। রাখাইনে সহিংসতার শিকার শিশুরা এত দিন এক ধরনের ভয়-আতঙ্কে ছিল। এসব কাটিয়ে তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে।

রোহিঙ্গা নেতা কালা মিয়া (৫৮) বলেন, রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন মক্তব-মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে আর কিছু পড়ানো হতো না। ফলে তারা কখনো মূল স্রোতে মিশে কাজ করতে পারত না।

উখিয়ার ক্যাম্প-১৭ এলাকার পাহাড়চূড়ায় টিনের ছাউনি আর বাঁশের বেড়ার একটি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র (লার্নিং সেন্টার) আছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ৪০ জনের মতো শিশু মেঝেতে বসে পড়ছে। শিশুদের বয়স ৬ থেকে ১৪ বছর। কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে বেসরকারি ‘সমাজ কল্যাণ উন্নয়ন সংস্থা’ বা স্কাস।

স্কাসের শিক্ষা প্রকল্প কর্মকর্তা আবদুল কাইয়ূম বলেন, ইউনিসেফের সহযোগিতায় তাঁরা রোহিঙ্গা শিশুদের এলসি লেভেল-১ ও লেভেল-২ দুই ভাগে পড়াচ্ছেন চারটি বিষয়ে। বিষয়গুলো হচ্ছে ইংরেজি, বর্মিজ ভাষা, গণিত ও লাইফ স্কিল। দুই শিফটে (সকাল ৯-১২টা ও দুপুর ১-৪টা) মোট ৮০ জন শিশুকে সপ্তাহের ছয় দিন (শুক্রবার বন্ধ) পড়ানো হয়।

উখিয়ার বালুখালী, লম্বাশিয়া, জুমশিয়া, কুতুপালং, হাকিমপাড়া, জামতলী ও শফিউল্লাহকাটা আশ্রয়শিবিরেও শতাধিক শিক্ষাকেন্দ্রে পড়ছে কয়েক হাজার শিশু। শিশুদের পড়ানোর জন্য প্রতিটা কেন্দ্রে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একজন বাংলাদেশি ও একজন রোহিঙ্গা শিক্ষক।

কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নারী সলিমা খাতুন (৪৫) বলেন, আশ্রয়শিবিরে আসার এক বছরের মাথায় তাঁর ১৫ বছর বয়সী মেয়ে রহিমার বিয়ে হয়েছিল। চার মাসের মাথায় সেই বিয়ে ভেঙে যায়। রাখাইনে তাঁর বিয়ে হয়েছিল ১৪ বছর বয়সে। বাংলাদেশে এসে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি বাল্যবিয়ে, যৌতুক, পরিবার পরিকল্পনা, যৌন হয়রানি, শিশু সুরক্ষার মতো অনেক কিছু জানতে পারছে।

ইউনিসেফ বলছে, সুযোগ থাকার পরও প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শিশু শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে না। কেন তারা স্কুলে যাচ্ছে না তা খুঁজে বের করে তাদের স্কুলমুখী করার চেষ্টা চলছে।