
রংপুরের পীরগাছা উপজেলা বাজার। চায়ের দোকানে ঢুকলেন আবদুল করিম মিয়া। একটা টুলে সদ্য এইচএসসি পাস করা অনন্তরাম গ্রামের মোফাজ্জল বসা। করিম তাঁর পাশে বসলেন। মোফাজ্জল ইংরেজিতে কিছু একটা বললেন। তার অর্থ বোঝার সাধ্য নেই করিম মিয়ার। তবে কয়েকজন তরুণ খদ্দেরের হাসাহাসি দেখে বুঝলেন, হয় গালি দেওয়া হয়েছে, না হয় বিদ্রূপ করা হয়েছে তাঁকে। অপমানিত করিম মিয়া পড়াশোনা করার প্রতিজ্ঞা করলেন।
এই গল্প ১৯৬৫ সালের। তাতে ২৬ বছরের করিম মিয়া ছিলেন তুচ্ছ এক চরিত্র। এখন ২০১৪ সাল। আজ ৭৫ বছরের করিম মিয়া অসাধারণ এক গল্পের নায়ক। এই গল্প তাঁর জীবনেরই গল্প।
করিম মিয়া বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেছেন। এইচএসসি পড়েছেন বড় মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে। দুই বছর বিরতি দিয়ে পাস করেছেন স্নাতক (বিকম)। এলাকায় পাঁচটি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। দিনমজুর বাবার নামে তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়টি তিনি এইচএসসি পাসের পরের বছরই সরকারি হয়ে গেছে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ তাঁকে ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে পুরস্কৃত করেছেন। হয়েছেন রংপুর বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষানুরাগী। ২০১১ সালে সেই জাতীয় পুরস্কারটি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পীরগাছার গুয়াবাড়ী গ্রামে ১৯৩৯ সালে করিম মিয়ার জন্ম। বাবা নাছু মামুদ ছিলেন দিনমজুর। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় মা করিফুল নেছা মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করেন।
ঘরে দারিদ্র্যের সঙ্গে যুক্ত হলেন সৎমা সুফিয়া বেগম। করিম বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করলে সৎমা তাঁকে বোঝান, ‘বাবা, হামরা গরিব মানুষ। দুই বেলা খাবার জোটে না। তোর পড়ার খরচ পাই কোনঠে!’
বিদ্যালয় ছেড়ে শিশু করিম অন্যের বাড়িতে কামলা খাটতে যান। দিনমজুরিই হয়ে ওঠে তাঁর পেশা। কিছু টাকা জমিয়ে ১৯৫৪ সালে ধান ও পাটের রাখি ব্যবসা শুরু করেন। সেই আয় থেকে একে একে ছয় একর জমি কেনেন। এক দোন (২২ শতক) জমির দাম তখন ১০০ টাকা। কেনেন একটি ছোট্ট চালকলও।
লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছাটা কিন্তু ছিলই করিমের মনে। চায়ের দোকানে তরুণ মোফাজ্জল (পরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, এখন প্রয়াত) ঠাট্টাচ্ছলে করিমের সেই ইচ্ছাটাকে জেদে পরিণত করলেন।
পড়ালেখা ছাড়ার ১৫ বছর পর ১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে কাউকে কিছু না বলে পীরগাছা জে এন উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন করিম। তত দিনে তিনি বিবাহিত। তাতে কী? বই-খাতা নিয়ে বিদ্যালয়ে হাজির করিম মিয়া। শিক্ষার্থীরা তাঁকে দেখে বিস্মিত। হাসি-ঠাট্টাও কম হলো না।

‘আমি কিন্তু লজ্জা পাইনি। সমাজে লেখাপড়া না জানা মানুষের যেমন দাম নেই, তেমনি লেখাপড়ার কোনো বয়সও নেই।’ পুরোনো সেই ঘটনা যেন জ্বলজ্বল করছে করিমের স্মৃতিতে।
১৯৭০ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন করিম। ভর্তি হন পীরগাছা ডিগ্রি কলেজে। তার আগে নিজের কেনা জমির ৮০ শতক দান করেন কলেজটিকে। ১৯৭২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। বিকমে ভর্তি হন একই কলেজে। কিন্তু গাইবান্ধায় কেন্দ্র পড়ায় সেবার পরীক্ষা দেননি তিনি।
করিম মিয়া বললেন, ‘তখনকার দিনে তো থানা পর্যায়ে পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল না। এখান থেকে গাইবান্ধার যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ ছিল। তার ওপর আমার ব্যবসায়িক কাজের চাপ ছিল খুব। তাই পরীক্ষা দিইনি। দুই বছর পর পরীক্ষা দিয়েছি এবং দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছি।’ শুধু পড়ালেখা করে সময় কাটেনি করিম মিয়ার। সংসার, ছেলেমেয়ে ছিল। তাঁর পাটের ব্যবসা তত দিনে বড় হয়েছে। গুদামে বসতেন নিজেই। গুদামেই তাঁর আলাদা পড়ার কক্ষ ছিল। কখনো ক্লাস কামাই করেননি।
তাঁর সহপাঠী এবং পরে বড় মেয়ের জামাই মোজাম্মেল হোসেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার শ্বশুরের মধ্যে নিয়মিত ছাত্রের সব গুণই ছিল। সে সময় কমার্স পড়া এবং পাস করা অনেক কঠিন ছিল।’
মোজাম্মেল হোসেন কারমাইকেল কলেজ থেকে অনার্স এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে সেই পীরগাছা ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন। অনার্স প্রথম বর্ষেই করিম মিয়ার দশম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। মোজাম্মেল হোসেন এখন অবসর জীবনযাপন করছেন।
করিমের কর্মময় জীবন: লেখাপড়ার পাশাপাশি ১৯৭২ সালে এলাকাবাসীকে নিয়ে করিম স্থাপন করেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৫৭ শতাংশ জমি দান করেন তিনি। করিম বলেন, ‘গ্রামের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে ভিক্ষা চাইলাম। কারও কাছে ধান, কারও কাছে মুষ্টির চাল। বিদ্যালয়ের ঘর তৈরি করলাম। সে সময়ের শিক্ষা কর্মকর্তাও উৎসাহ দিলেন।’
পরের বছর বিদ্যালয়টি সরকারি করা হয়। নাম রাখা হয় করিমের বাবার নামে, নাছু মামুদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ৭৩৫। শিক্ষক আছেন ১৬ জন।
২০ বছর ধরে ফলাফলের দিক দিয়ে বিদ্যালয়টি উপজেলায় সেরা অবস্থান ধরে রেখেছে। ১৯৯৮ সালে এটি রংপুর বিভাগের সেরা বিদ্যালয়ও হয়েছিল। করিম মিয়া ২৩ বছর ধরে বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সভাপতি। প্রতিদিন তিনি বিদ্যালয়ে যান। দেখভাল করেন। কোথাও ময়লা দেখলে নিজেই ঝাড়ু হাতে নেমে পড়েন।
নাছু মামুদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী মোর্শেদা আক্তার প্রথম আলোকে বলল, ‘একদিন স্কুলে না আসলে পরের দিন বাড়িতে গিয়ে হাজির হন করিম দাদু।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহানারা বেগম বলেন, ‘করিম চাচা এখনো নিজ হাতে তালা খুলে শ্রেণীকক্ষ পরিষ্কার করেন।’
১৯৭৫ সালে ৬০ শতক জমিতে গড়ে তোলেন আবদুল করিম মিয়া আবাসিক শিক্ষানিকেতন। এতে আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পড়ালেখায় অমনোযোগী ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত পাঠদানের ব্যবস্থা করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটিতে আবাসিক শিক্ষার্থী আছে ৮০ জন, অনাবাসিক ৬০ জন। এরা দুই বেলা এসে পড়াশোনা করে বাড়ি ফিরে যায়।
এলাকার আটজন শিক্ষিত তরুণ-তরুণী সকালে ও সন্ধ্যায় এদের পড়ান। তাঁদের বেতন-ভাতা দেন করিম মিয়া। শিক্ষার্থীদের খাওয়ার খরচ দেন অভিভাবকেরা।
২০০১ সালে করিম মিয়া প্রতিষ্ঠা করেন পীরগাছা দারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা। এর ছাত্র ১৬৫, শিক্ষক আছেন ১২ জন।
২০০৩ সালে আদর্শ প্রতিভা শিক্ষানিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন করিম মিয়া। আটজন শিক্ষক। আবাসিক-অনাবাসিক মিলে শিক্ষার্থী ২১৫। এখানেও গরিব শিশুদের দুই বেলা পাঠদান করা হয়।
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তালুক ইসাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৪৯ জন শিক্ষার্থীর এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক আছেন চারজন। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেন করিম মিয়া। তালুক ইসাদ এখন রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়।
সব কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই করেছেন নিজের জমিতে, নিজের টাকায়। এগুলোর অবস্থান পীরগাছা সদর ইউনিয়নে। দুটি চালের কল আর একটি পেট্রলপাম্পের আয় থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় মেটান করিম মিয়া।
পীরগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফছার আলী বললেন, এই একজন লোকের চেষ্টাতেই আজ পীরগাছা শিক্ষার আলোয় আলোকিত।
করিম মিয়া বিয়ে করেছিলেন ১৬ বছর বয়সে। তাঁর চার মেয়ে, চার ছেলে। তাঁদের পড়ালেখা করিয়েছেন। সবাই বিয়েথা করে এখন নিজস্ব সংসারে। চার ছেলে নিজ নিজ ব্যবসা দেখেন। স্ত্রী নবিজন নেছার কাছে করিম মিয়া একজন পরোপকারী মানুষ, যিনি নিজের সংসারের চেয়ে অন্যের জন্য বেশি ব্যস্ত থাকেন।
করিম মিয়ার রোজনামচাও তাই বলে। তিনি সকালে নাশতা করে ঘর ছাড়েন। প্রথমে যান আবাসিক দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সেখানে টেবিল পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে পাঠদান, শিশুদের খাওয়া-দাওয়া—সব নিজ হাতে তদারক করেন। ১১টার পরে যান তাঁর প্রতিষ্ঠিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দুপুরে খাবারের জন্য বাড়ি ফেরেন। আবার বেরিয়ে পড়েন বিকেলবেলা। যান দুই আবাসিক প্রতিষ্ঠানে। শিশুদের রাতের খাবার খাইয়ে ১০টার দিকে বাড়ি ফেরেন।
জীবনে হাল না ছাড়া করিম মিয়া এখন পীরগঞ্জের শিশুদের কাছে করিম দাদু। তিনি তাদের অভিভাবক, অনুপ্রেরণা।
এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে কৃষিকাজ শুরু করেছিলেন মাঝবাড়ীপাড়া গ্রামের আফতাব হোসেন। করিম দাদু তাঁকে ধরে এনে আবার পড়ার টেবিলে বসালেন। আফতাব বললেন, ‘করিম দাদুর চেষ্টায় আবার পরীক্ষা দিয়ে পাস করি।’ আফতাব এখন ডিগ্রি পাস করে চাকরি করছেন।
পীরগাছা উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মকবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘করিম দাদুর জীবনটাই একটা গল্প।’ ‘এমন গল্প হয়ে ওঠা নিঃস্বার্থ মানুষ সমাজে বিরল’—মন্তব্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হরিশংকর সরকারের।
পীরগাছা জে এন উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র রিপন মিয়া বলল, ‘ষষ্ঠ শ্রেণীতে বাবা আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দেন। খবর পেয়ে করিম দাদু আমাদের বাড়িতে আসেন এবং আমার পড়ালেখার দায়িত্ব নেন।’
অসংখ্য শিশুর স্বপ্নের নির্মাতা করিম দাদুর একটি স্বপ্ন আছে। তিনি চীন দেশে যেতে চান। ৭৫ বছর বয়সী আবদুল করিম মিয়া প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমার একটা স্বপ্ন হলো চীন দেশ সফর করা। শুনেছি, সে দেশে পড়ানোর ব্যবস্থাটা উন্নত মানের। সে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে তাদের পড়ানোর কৌশলগুলো শিখে নিতে পারলে আমার শিশুগুলোর জন্য তা কাজে লাগানো যেত।’