ঐতিহ্য
শীতের ওম, খেজুরের রস
যশোর জেলায় বছরে গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার মেট্রিক টন গুড়-পাটালি উৎপাদিত হয়। জেলায় মৌসুমে রস, গুড় ও পাটালির বাণিজ্য হয় ৬৩ কোটি টাকার বেশি।
‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’ আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই প্রবাদটি যশোরের ক্ষেত্রে আজও প্রাসঙ্গিক। খেজুরের রসে গলা ভেজাননি এমন বাঙালি কমই আছেন। খেজুরের এই রস দিয়ে তৈরি গুড়-পাটালি ছাড়া শীতকালটা যেন জমে না। গুড়-পাটালি দিয়ে তৈরি পিঠাপুলি-পায়েসের নাম শুনলেই জিবে পানি আসে।
এই খেজুরের গুড় উৎপাদন এখন বাণিজ্যিক রূপ পাচ্ছে। আবার সনাতন বাজারব্যবস্থার বাইরে খেজুরের গুড়ের অনলাইন বাণিজ্যও হচ্ছে।
খেজুরের গুড়ের পিঠাপুলি-পায়েস দেশের শত বছরের ঐতিহ্য। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে (১৯১৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত) যশোরের খেজুরের গুড়ের উল্লেখ আছে। ওই বর্ণনা অনুযায়ী, ১৯০০-০১ সালে পূর্ব বঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে প্রায় ২২ লাখ মণ, যা প্রায় ৮২ হাজার টনের সমান।
বাণিজ্য ও ব্র্যান্ডিং
যশোরে প্রাকৃতিকভাবেই খেজুরগাছ হয়। দিগন্তজোড়া মাঠে খেজুরগাছের দীর্ঘ সারি। অপরিকল্পিতভাবে সড়কের পাশে, খেতের আইলে, বাড়ির আঙিনায়, উঁচু জমিতে রয়েছে সারি সারি খেজুরগাছ।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলার আট উপজেলায় মোট ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি খেজুরগাছ আছে। এর মধ্যে রস হয়, এমন গাছ রয়েছে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৫টি। সবচেয়ে বেশি খেজুরগাছ রয়েছে যশোর সদর, মনিরামপুর, শার্শা, চৌগাছা ও বাঘারপাড়া উপজেলায়। একটি গাছ থেকে মৌসুমে গড়ে প্রায় ১৫০ লিটার রস পাওয়া যায়। ওই রস জ্বালিয়ে প্রায় ১৫ কেজি গুড় হয়। জেলায় বছরে গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার মেট্রিক টন গুড়-পাটালি উৎপাদন হয়। জেলায় মৌসুমে রস, গুড় ও পাটালির বাণিজ্য হয় ৬৩ কোটি টাকার বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, যশোরে খেজুরের গুড় ও পাটালির বাণিজ্য ক্রমে সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রচলিত বাজারব্যবস্থার বাইরে খেজুরের গুড়ের অনলাইন বাণিজ্যও হচ্ছে। জেলায় বিশুদ্ধ ও নিরাপদ গুড়-পাটালি উৎপাদন বেড়েছে। এতে গাছিরা লাভবান হচ্ছেন। বিশুদ্ধ ও নিরাপদ গুড়-পাটালি উৎপাদনে তাঁরা গাছিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
খেজুরের গুড়কে জেলার ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘নানান রঙের ফুলের মেলা, খেজুর গুড়ের যশোর জেলা।’
জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, খেজুর গুড়ের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে এবং নতুন আঙ্গিকে বিশ্বদরবারে পরিচিতি করার লক্ষ্যে খেজুর গুড়কে যশোরের জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
‘গাছ তোলা’
গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে খেজুরের গাছ তোলা (গাছের উপরিভাগ চেঁছে পরিষ্কার করা) হয়। কয়েক দিন রেখে দিয়ে গাছের তোলা অংশ শুকানো হয়। অগ্রহায়ণের শেষে খেজুরগাছ চেঁছে ওপরের দিকে দুটি চোখ কাটা হয়। নিচের দিকে বাঁশের নল বা নলি পোঁতা হয়। দুই চোখের মাঝ থেকে কেটে নল বা নলি পর্যন্ত একটি সরু পথ তৈরি করা হয়। নল বা নলির নিচে দড়ি দিয়ে মাটির তৈরি ভাঁড় ঝোলানো হয়। প্রতিবার চোখ দুটি কাটা হয়। চোখ থেকে পথ দিয়ে বেয়ে রস মাটির ভাঁড়ে এসে জমা হয়।
গাছিরা জানান, খেজুরের রস বিক্রি হয় ৭ থেকে ১০ কেজি ওজনের প্রতি মাটির ভাঁড় ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়, গুড় বিক্রি হয় ২০০ টাকা এবং পাটালি বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে।
২৫ বছর ধরে গুড়-পাটালি উৎপাদন করছেন যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকুলা গ্রামের গাছি ওয়াজেদ আলী (৫৮)। তিনি বলেন, ‘আমি এবার ৬০টি গাছ কাটছি। এর মধ্যে ৫৫টি গাছ আমার নিজের। পাঁচটি গাছ বর্গা নিয়েছি। প্রতিদিন পর্যায়ক্রমে ২০টি করে গাছ কাটব। প্রতিদিন ১০-১২ ভাঁড় রস হবে। গত বছর কাঁচা রস ১৫০ টাকা করে বিক্রি করেছি। একদিন গাছ কাটলে যে রস পাওয়া যায়, তা দিয়ে আমার আট কেজি গুড়-পাটালি হয়। গুড় ২০০ টাকা করে বিক্রি করেছি। পাটালি প্রথমে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি।’
রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি
গাছ কাটার পরের দিন ভোরবেলায় খেজুরগাছ থেকে রসভর্তি মাটির ভাঁড় নামিয়ে আনেন গাছি। পাঁচ দিন বিরতি দিয়ে আবার গাছ কাটা হয়। একবার গাছ কাটলে তিন দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রসকে বলে ‘জিড়ানকাট’। এ রস জ্বাল (তাপ) দিয়ে তৈরি করা হয় ভালো পাটালি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে রসের পরিমাণ কমতে থাকে। দ্বিতীয় দিনের রসকে ‘দোকাট’ ও তৃতীয় দিনের রসকে ‘তেকাট’ বলে। এই রস দিয়ে ঝোল গুড় বা চিটাগুড় তৈরি হয়।
মাটির তৈরি পাত্র ‘নানদা’ অথবা টিনের তৈরি ‘তাফালে’ রস রেখে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। তবে পাটালি তৈরি করতে রস অনেকক্ষণ জ্বাল দিতে হয়। গুড় গাঢ় হলে উনুন থেকে নামিয়ে নানদা বা তাফালের একপাশে কিছুটা গুড় নিয়ে ছোট করে কাটা খেজুরপাতার ডাঁটা দিয়ে গুড় ঘষে সাদা করা হয়। একে ‘বীজ মারা’ বলে। এরপর বীজ গুড় অবশিষ্ট গুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। শেষে পলিথিন অথবা কলার পাতার ওপর গুড় ঢেলে শুকিয়ে পাটালি তৈরি করা হয়।
লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য
মনমাতানো ঘ্রাণ আর রসনা তৃপ্ত করা স্বাদের নলেন গুড়ের জুড়ি নেই। মৌসুমের শুরুতে খেজুরগাছ চেঁছে বাঁশের নল বা নলি পোতা হয়। নলি পোতার পর প্রথমবার সংগ্রহ করা রস থেকে তৈরি গুড়কে ‘নলেন গুড়’ বলে। এই রস কিছুটা নোনতা। অপূর্ব স্বাদ ও মনমাতানো গন্ধ এই নলেন গুড়ে। নলেন গুড় থেকে তৈরি হয় সুস্বাদু সন্দেশ, প্যাড়া সন্দেশ, ক্ষীর-পায়েস।
অনলাইনে বেচাকেনা
২০১৮ সাল থেকে যশোরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে গুড়-পাটালি বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বাজার কিছুটা সম্প্রসারণ হচ্ছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কেনারহাটের অন্যতম উদ্যোক্তা নাহিদুল ইসলাম বলেন, জেলার চারটি উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের ৫০০ জন প্রশিক্ষিত গাছির কাছ থেকে ভেজালমুক্ত গুড় ও পাটালি কেনা হচ্ছে। গত মৌসুমে তাঁরা প্রায় ২০ হাজার কেজি গুড় ও পাটালি অনলাইনে বিক্রি করেছেন। এ মৌসুমে তাঁদের ৩৭ হাজার কেজি গুড় ও পাটালি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘খেজুরের গুড় যশোর’ নামের একটি পেজ রয়েছে। এটির মালিক যশোরের মনিরামপুর উপজেলার হেলাঞ্চি গ্রামের সাদ্দাম হোসেন। তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে তিনি পেজটি খুলেছেন। ওই বছরই অনলাইনে তিনি ২০০ কেজি খেজুরের গুড় ও পাটালি বিক্রি করেন। গত মৌসুমে তাঁর গুড় ও পাটালি বিক্রি হয়েছে ৭৫০ কেজি। এ মৌসুমে তাঁর বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার কেজি। তাঁর চাচা আবুল গাজী খেজুরের গুড়-পাটালি তৈরি করেন।
যশোরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে গুড়-পাটালি বিক্রি করে। তাদের মধ্যে রয়েছে ‘গ্রামের হাট’। এর উদ্যোক্তা এস এম আরিফুজ্জামান। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষে জেলা ব্র্যান্ডিং পণ্য হিসেবে কাজ করছে এবং ই-কমার্সগুলোর সেবা ভোক্তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে ‘যশোর হাট’।
আসল পাটালি চিনতে
৩৬ বছর ধরে খেজুরের গাছ কাটছেন বাঘারপাড়া পৌরসভার মধ্যপাড়া এলাকার কৃষক শমসের আলী (৬৬)। তিনি বলেন, ভেজাল গুড়-পাটালি চকচক করে। গুড়ের সঙ্গে চিনি মেশালে পাটালি খুব শক্ত হয়। রসাল থাকে না। পাটালির রং কিছুটা সাদা হয়। গুড়ে হাইড্রোজ এবং ফিটকিরি ব্যবহার করলে পাটালির রং সাদা হয়। পাটালি ভীষণ শক্ত হয়। খেজুরের খাঁটি পাটালি চকচক করে না। রং কিছুটা লাল-কালচে হয়। পাটালি নরম এবং রসাল হয়। অনেক সময় পাটালির ওপরের অংশ কিছুটা শক্ত হতে পারে, কিন্তু ভেতরটা রসাল হয়।