শেরপুরের ঐতিহ্য চারু ভবন

শেরপুর জেলা শহরের চাল ব্যবসার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র গোপালবাড়ী বটতলা। এই বটতলা মোড় থেকে সামান্য উত্তর দিকে তাকালেই দেখা যায় সুন্দর কারুকার্য করা দৃষ্টিনন্দন লাল রঙের একটি দ্বিতল ভবন। এ ভবনের নাম ‘চারু ভবন’। এটি প্রায় দেড় শতাব্দীর পুরোনো শেরপুর পৌরসভার নিজস্ব ভবন।
৮৬ বছর আগে নির্মিত এ ভবনটি এত দিন শেরপুর পৌরসভার কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সম্প্রতি নির্মিত পৌরসভার নতুন ভবনে পৌর কার্যালয় স্থানান্তরিত হয়েছে। তবে এখনো চারু ভবনে পৌরসভার পানি শাখাসহ কয়েকটি বিভাগের কাজ চলছে। কিছুদিন আগে পৌর কর্তৃপক্ষ ভবনটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে।
বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল নয়আনী বাড়ির জমিদার হরচন্দ্র রায় চৌধুরীর সহযোগিতা ও ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শেরপুরে প্রথম পৌরসভা স্থাপিত হয়। এর প্রথম প্রশাসক ছিলেন জামালপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক টি এ ডনো। শহরের গোপালবাড়ী এলাকার একটি টিনের ঘরে শেরপুর পৌরসভার প্রথম কার্যক্রম শুরু হয়। জমিদার হরচন্দ্র রায় চৌধুরী ১৮৮৬-৮৮ সময়কালে শেরপুর পৌরসভার নির্বাচিত প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন। এই পৌরসভার আয়তন ২৪ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে জনসংখ্যা লক্ষাধিক। ১৯৯৪ সালে শেরপুর পৌরসভা প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হয়। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া মেয়র পদে জয়ী হন।
পৌর ভবনের নাম চারু ভবন রাখার পেছনে রয়েছে একটি ইতিহাস। জানা যায়, ১৯৩০ সালে হেমন্ত চন্দ্র চৌধুরী চেয়ারম্যান থাকাকালে পৌর ভবনের মূল অংশটি নির্মিত হয়। এ নির্মাণকাজে ব্যয় হয় ১০ হাজার টাকা। এর মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায়। এই টাকায় ভবনের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন হেমন্ত চন্দ্র চৌধুরী নিজেই এগিয়ে আসেন। তিনি তাঁর বাবা রায় বাহাদুর চারু চন্দ্র চৌধুরীর নামানুসারে পৌর ভবনটির নাম ‘চারু ভবন’ রাখার শর্তে অবশিষ্ট পাঁচ হাজার টাকা দান করেন। সেই থেকে শেরপুর পৌর ভবন চারু ভবন হিসেবে অভিহিত হয়ে আসছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, লাল রঙের ইটের গাঁথুনিতে নির্মিত চারু ভবনের দেয়ালের কাজ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এটির নিচ ও দোতলায় আছে যথাক্রমে পাঁচ ও দুটি করে কক্ষ। ভবনটির নিচ ও দোতলায় আছে কাঠের তৈরি ৮টি দরজা ও ২০টি জানালা।
বর্তমান মেয়র গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া গত বছরের ৯ নভেম্বর শেরপুর পৌরসভার ঐতিহ্যবাহী চারু ভবনকে জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। এই ভবনে বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য, আদি নিদর্শন, পুরাকীর্তি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও নিদর্শন সংরক্ষণ করা হবে, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ অঞ্চলের সঠিক ইতিহাস জানতে পারে। সেই সঙ্গে দেশ ও বিদেশ থেকে আসা পর্যটকেরা এ ভবনটি দেখে শেরপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে যথাযথ ধারণা পাবেন।
মেয়র বলেন, চারু ভবনের চারটি কক্ষকে পৃথক গ্যালারি করে সেগুলোকে পৌরসভার ইতিহাস-ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন, শেরপুরসংক্রান্ত প্রকাশনা ও শেরপুর অঞ্চলের সাধারণ তথ্যাবলি ও নিদর্শন দিয়ে সাজানো হবে। এ জন্য তিনি শেরপুরবাসীর সহায়তা কামনা করে এ-সংক্রান্ত নিদর্শন দিয়ে পৌর জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করার আহ্বান জানান। আগামী বছরের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে ।
শেরপুর ইতিহাস পরিষদের আহ্বায়ক ফকির আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী চারু ভবনকে জাদুঘর হিসেবে রূপান্তরের পৌরসভার এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। এর মাধ্যমে এ ভবনটি সংরক্ষণ সম্ভব হবে এবং নতুন প্রজন্ম শেরপুর অঞ্চল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে পারবে।’