সেই ছেলেবেলায় প্রাণীটিকে দেখেছিলাম ঢাকা চিড়িয়াখানায়। কালচে-বাদামি মুখের ওপর ওর সাদা গোঁফগুলো আজও ভুলতে পারিনি। এরপর বহুবার ওকে দেখেছি বিশ্বের বহু চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কে। দাঁত-মুখ খিঁচানো অবস্থায় হিংস্র দেখালেও আদতে কিন্তু প্রাণীটি একেবারেই নিরীহ। চিড়িয়াখানার বাইরে অর্থাৎ বুনো পরিবেশে নিশাচর এই প্রাণীকে দেখার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। আজ পর্যন্ত কোনো মানুষ ওর আক্রমণের শিকার হয়েছে বলে শুনিনি। তবে মানুষ ওকে আঘাত করেছে বারবার এবং অহেতুক। কখনোবা করে বন্দী। আর বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করতে পারলে স্থান হয় চিড়িয়াখানা বা সাফারি পার্কে। যেমনভাবে অপরাধীদের জায়গা হয় জেলহাজতে।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে আমার এক বিশ্বস্ত লোকের কাছে খবর পেলাম, সপ্তাহখানেক আগে শহরের একজনের ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা (যা আইনে অবৈধ) থেকে একটি হিমালয়ান শকুন ও খাটোলেজি বানরের সঙ্গে একজোড়া সাদা গোঁফের বিরল প্রাণীও জব্দ করে বন বিভাগ। প্রাণীগুলো কদিন শ্রীমঙ্গলের জানকিছড়া বন্য প্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে রেঞ্জার শহীদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে থাকার পর সাদা গোঁফের প্রাণী দুটোকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করা হয়। আর শকুন ও বানরটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। হয়তো বাকি জীবন ওরা পার্কের বন্দিদশায় থেকেই একদিন মরে যাবে। আর সাদা গোঁফের প্রাণীগুলো হয়তো টিকে যাবে প্রকৃতিতে, অন্তত আমার একান্ত কামনা সেটাই। তবে যতটুকু শুনেছি, ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার মালিক প্রাণীগুলোকে ১০-১৫ বছর আগে জোগাড় করেছিল। কাজেই দীর্ঘদিন বন্দিদশায় থাকার পর বুনো পরিবেশে ওরা টিকতে পারবে কি না সন্দেহ। আর সাফারি পার্কে পাঠানো প্রাণীগুলোর অবস্থা কি জেলহাজতের কয়েদিদের চেয়ে ভালো হবে?
যাদের থাকার কথা ছিল মুক্ত-স্বাধীন পরিবেশে, তারা আজ কোন অপরাধে হাজতবাস করবে? আমাদের শখের খেসারত কেন তাদের দিতে হবে? এত বছর পর এদের উদ্ধার করেই–বা লাভ কী? আসলে ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ এই প্রবাদবাক্যের সত্যিকারের অর্থ মানুষ যত দিন না বুঝবে, তত দিন বন্য প্রাণী সংরক্ষণের কিছুই হবে না। মানুষ কি আসলে বন্য প্রাণী ও প্রকৃতির সংরক্ষণ চায়? দুঃখের বিষয়, এভাবে চলতে থাকলে একদিন এ দেশে আর একটি বন্য প্রাণীও অবশিষ্ট থাকবে না।
এতক্ষণ সাদা গোঁফের যে প্রাণী জোড়ার কথা বললাম, ওরা এ দেশের এক সংকটাপন্ন ও বিরল স্তন্যপায়ী প্রাণী বাঁশভালুক। গাছ ফেউয়া, গেছো ভল্লুক বা ভামাকার ভল্লুক নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম বিন্টুরং, বিয়ারক্যাট বা এশিয়ান বিয়ারক্যাট। তবে নামে ভালুক হলেও ভালুক গোত্রের কোনো প্রাণী নয় ওরা। বরং খাটাশ, বাগডাশ বা গন্ধগোকুলদের সঙ্গে একই গোত্র ভাইভেরিডির অন্তর্ভুক্ত। বাঁশভালুকের বৈজ্ঞানিক নাম Arctictis binturong। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে এদের দেখা যায়।
এরা এক প্রজাতির গেছো গন্ধগোকুল, যা দেখতে অনেকটা ছোটখাটো ভালুকের মতো। দেহের দৈর্ঘ্য ৭৫-৯০ সেন্টিমিটার ও লেজ প্রায় ৭০ সেন্টিমিটার। ওজন ৯-২০ কেজি। দেহের লোম রুক্ষ ও অমসৃণ কালো; তাতে থাকে আংশিক সাদা ও হালকা হলুদের মিশেল। কানের কিনারা, ভ্রু ও গোঁফ সাদা।
চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন ও বাঁশবনের গহিনে অল্প কিছু এলাকায় এদের দেখা যায়। সন্ধ্যাচারী, নিশাচর ও বৃক্ষবাসী প্রাণীগুলো সচরাচর একাকী বিচরণ করে। দিনে সচরাচর গাছের খোঁড়লে ঘুমিয়ে থাকে। রাতে খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। সর্বভুক এ প্রাণীগুলোর খাদ্যতালিকায় রয়েছে ছোট মেরুদণ্ডী প্রাণী, অমেরুদণ্ডী প্রাণী, পাখি, মাছ, কীটপতঙ্গ, ফল (বিশেষত বট) ইত্যাদি।
এরা বছরের যেকোনো সময় প্রজনন করতে পারে। তবে জানুয়ারি থেকে মার্চেই বেশি করে। স্ত্রী ৯০-৯২ দিন গর্ভধারণের পর দুই থেকে ছয়টি বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চারা ২৮-৩০ মাসে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। আয়ুষ্কাল বুনো পরিবেশে প্রায় ১৮ বছর ও আবদ্ধাবস্থায় ২৫ বছর।