বড় শহর: কুষ্টিয়া—১৫
সংস্কৃতির তীর্থেই থমকে গেছে সংস্কৃতিচর্চা
স্বাধীনতার ৫০ বছরে রাজধানী ঢাকা যেমন বড় হয়েছে, তেমনি সম্প্রসারিত হয়েছে দেশের পুরোনো শহরগুলোও। বড় শহরের পরিবর্তন ও বাসযোগ্যতা নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনে এবার কুষ্টিয়া।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্য রস–সাধনার তীর্থস্থান’, সুসাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, ফকির লালন শাহর ‘আরশিনগর’, লেখক-সম্পাদক ও সমাজসংস্কারক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ও কালজয়ী ‘বিষাদ–সিন্ধুর’ রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের জন্মস্থান এই কুষ্টিয়া। এত কবি, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিজনের বিচরণ যে জেলায়, যে জেলাকে বলা হয় সংস্কৃতির রাজধানী, সেখানে সংস্কৃতিচর্চা আর আগের মতো নেই।
কুষ্টিয়ায় একসময় প্রচুর পাট হতো। পাটকে স্থানীয়রা ‘কোষ্টা’ বা ‘কুষ্টা’ বলতেন, যার থেকে কুষ্টিয়া নামটি এসেছে। কারও মতে, ফারসি শব্দ ‘কুশতহ’ থেকে কুষ্টিয়ার নামকরণ হয়েছে, যার অর্থ ‘ছাই দ্বীপ’। আবার সম্রাট শাহজাহানের সময় কুষ্টি বন্দরকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের উৎপত্তি বলেও একটি মত রয়েছে।
দেড় শ বছরের পুরোনো শহর কুষ্টিয়ায় পুরোনো অনেক কিছুই বন্ধ হয়ে গেছে। উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বস্ত্র কারখানা মোহিনী মিল বিকল হয়ে গেছে সেই আশির দশকে। সাম্প্রতিক সময়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিখ্যাত কুষ্টিয়া চিনিকল। দেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন জগতির গতি নেই আগের মতো। ভরাযৌবনা নদী–খাল সব শুকিয়ে খাক হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি নতুন করে উন্মোচিত হয়েছে সম্ভাবনার নতুন দ্বার। জেলায় উৎপাদিত চাল আজ সারা দেশে সমাদৃত।
আধুনিক পৌরসভা, সমস্যা অনেক
১৭২৫ সালে কুষ্টিয়া নাটোর জমিদারির অধীনে ছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৭৬ সালে কুষ্টিয়াকে যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত করে। ১৮২৮ সালে এটি আবার পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৮৪ সালে মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা পৃথক হলে ছয়টি উপজেলা নিয়ে কুষ্টিয়া গঠিত হয়।
১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় কুষ্টিয়া পৌরসভা। ক শ্রেণির মর্যাদাভুক্ত এ পৌরসভার আয়তন ৪২ দশমিক ৭৯ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের ১৩তম বৃহৎ এ শহরে ২১টি ওয়ার্ডে মানুষ আছে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬ জন।
কুষ্টিয়া শহরে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা এখনও আংশিক। ৩৩ শতাংশ মানুষ পায় পৌরসভার পানি। হাউজিং ও বাইপাস এলাকা দিয়ে শহর বড় হচ্ছে, যেখানে-সেখানে ঘরবাড়ি করছে মানুষ। শহরের যত্রতত্র উঠছে বহুতল অট্টালিকা। কয়েকটি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতার সমস্যা রয়েছে। পাকা সড়ক থাকলেও অধিকাংশ ভাঙাচোরা। ভাঙাচোরা সড়ক আর যানজট এখন এই শহরের প্রধান সমস্যা।
কুষ্টিয়া পৌরসভার নগর–পরিকল্পনাবিদ রানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সালে একটি মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। ২০২১ সাল থেকে সেটা শুরু হয়েছে। আগামী ২০৩৭ সালের মধ্যে এ পরিকল্পনার কাজ শেষ হবে। এসব কাজ শেষ হলে একটা সুন্দর নগর গড়ে উঠবে।
জাগল না মরাগড়াই
কুষ্টিয়া পৌর এলাকার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে গড়াই খাল, যার নাম মরাগড়াই। একসময় নৌকা, ট্রলারসহ নৌযান চললেও খালটি দেখে তা বোঝার উপায় নেই। এটি মূলত পৌর এলাকার পানিনিষ্কাশনের জন্য ব্যবহার হয়। কয়েক বছর আগে খালটি আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে একটি প্রকল্প হাতে নেয় পৌর কর্তৃপক্ষ। সঠিক পরিকল্পনার অভাব, ঠিকাদারের গাফিলতিসহ নানা কারণে প্রকল্পটি ভেস্তে গেছে। ২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা খরচ হলেও যে পরিকল্পনা ও পৌরবাসীর সুবিধার জন্য খালটি খনন করা হচ্ছিল, তার কোনো কাজে আসছে না। বরং টাকা খরচ হলেও বাড়তি কোনো সুবিধা পাচ্ছে না নগরবাসী।
—১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় কুষ্টিয়া পৌরসভা।
—পৌরসভার আয়তন ৪২ দশমিক ৭৯ বর্গকিলোমিটার।
—২১টি ওয়ার্ডে মানুষ আছে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬ জন।
পৌর এলাকার কমলাপুর থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলবাড়িয়া হয়ে জগতি ছাড়িয়ে কলাবাড়িয়ায় গিয়ে ঠেকেছে খালটি। যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার। ২০১৮ সালে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে খাল খননের কাজ শুরু হয়। মাঝপথে খননকাজ বন্ধ হয়ে যায়।
জানতে চাইলে কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, পরিকল্পনায় কিছুটা ভুল থাকায় খাল খনন হলেও বাকি যে কাজ ছিল, তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। প্রকল্প এক প্রকার বাতিল হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্যসেবা নিতে চাপ বেশি
কুষ্টিয়া শহরে ৭৮টি বেসরকারি ক্লিনিক ও রোগনির্ণয় কেন্দ্র রয়েছে। আছে দুটি সরকারি হাসপাতাল। সরকারি ও বেসরকারি দুটি মেডিকেল কলেজ নির্মাণাধীন। তবে চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে কমবেশি প্রশ্ন রয়েছে। রোগীদের প্রায়ই উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা বা রাজশাহীতে স্থানান্তর করা হয়। বেসরকারি ক্লিনিক ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রোগীরা প্রতারণার শিকারও হন।
সরকারিভাবে চিকিৎসার জন্য কুষ্টিয়ায় মানুষের একমাত্র জায়গা কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। করোনারি কেয়ার ইউনিটের (সিসিইউ) ১৬টি শয্যাসহ এ হাসপাতালে এখন শয্যাসংখ্যা ২৬৬। সম্প্রতি বেসরকারি উদ্যোগে দুটি উন্নত আধুনিক মানের হাসপাতাল নির্মাণের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের মানুষের একদিকে যেমন কর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবাও পাবে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এ এস এম মুসা কবির প্রথম আলোকে বলেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কুষ্টিয়ায় স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক পরিবর্তন হবে। রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী বা ঢাকার মতো চিকিৎসাব্যবস্থা এখানে গড়ে উঠবে।
সংস্কৃতিচর্চায় স্থবিরতা
কুষ্টিয়া শহরে একসময় চারটি সিনেমা হল ছিল। বাণী, বনানী, গড়াই ও রকসী সিনেমা হল। বর্তমানে বনানী সিনেমা হল চালু আছে। তবে সেটাও শুধু বিশেষ উৎসবের সময় চলে। বাকিগুলো বন্ধ হয়ে সেখানে অন্য ব্যবসা–বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। কাগজে-কলমে কুষ্টিয়ায় সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে প্রায় ৫০টি। তবে সক্রিয় হাতে গোনা কয়েকটি।
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ কুষ্টিয়া শাখার সহসভাপতি সরওয়ার মুর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হলেও কুষ্টিয়ায় সংস্কৃতিচর্চা এখন স্থবির। কেন জানি না সংস্কৃতিচর্চায় মানুষ আর তাদের সন্তানদের পাঠাতে চাইছে না।
অবশ্য রবি ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত টেগর লজকে ঘিরে সংস্কৃতিচর্চা হয় এখনো। ঐতিহ্যমণ্ডিত ওই ভবনে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সদস্যরা সংস্কৃতিচর্চা করেন।
কুষ্টিয়ায় বিনোদনকেন্দ্রের সংখ্যা তুলনামূলক কম। পৌরসভা পরিচালিত ছোট দুটি শিশুপার্ক আছে। শহরের বাইপাস এলাকায় বেসরকারি উদ্যোগে একটি পার্ক সম্প্রতি চালু হয়েছে।
গণপরিবহন নেই
শহরে গণপরিবহনব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, মাইক্রোবাসই ভরসা। পৌরসভায় নিবন্ধিত ইজিবাইক আছে ২ হাজার ৩০০টি, রিকশা ১ হাজার ৫০০ ও ভ্যান রয়েছে ১০০টি। কিন্তু প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার ইজিবাইক ও রিকশা এ শহরে চলাচল করে। পৌর এলাকায় ইজিবাইক ও রিকশা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও তা কার্যকর করা যায়নি। শহরের মাঝখান দিয়ে রেললাইন গেছে। প্রতিদিন রেল চলাচলের কারণে অন্তত পাঁচটি পয়েন্টে কয়েক ঘণ্টা থমকে থাকে শহরের কার্যক্রম।
জলাবদ্ধতা
কুষ্টিয়া শহরের পানি নিষ্কাশিত হয় গড়াই নদ ও মান্নান খাল দিয়ে। কিছুটা পরিকল্পনায় আছে মরাগড়াই খাল দিয়ে পানিনিষ্কাশনের। শহরের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এ খাল। আট কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি সংস্কারের অভাবে কাজে আসে না। গড়াই নদে পানিনিষ্কাশনের সঙ্গে বর্জ্যপদার্থ পড়ে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। শহরের নালাগুলো দিয়ে ঠিকমতো পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে কয়েকটি ওয়ার্ডে বর্ষাকালে পানি জমে যায়। দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।
পৌরসভার নগর–পরিকল্পনাবিদ রানভীর আহমেদ বললেন, শহরের উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে পানিনিষ্কাশনের অন্তত ২০টি বড় নালা রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে অলিগলির ছোট নালাগুলোর সঙ্গে প্রধান নালাগুলোর সংযোগ ঠিকমতো নেই। এতেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
শিক্ষার সুবিধা
কুষ্টিয়ার কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী স্কুল তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে কুষ্টিয়া হাইস্কুল, মুসলিম হাইস্কুল ও মোহিনী মোহন বিদ্যাপীঠ।
কুষ্টিয়া শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুরোনো বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ আগের মতো আর নেই। ভৌগোলিক কারণে এ শহরে শিক্ষা গ্রহণের জন্য আশপাশের জেলাগুলো থেকে অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের পড়াতে আগ্রহী। আর উচ্চশিক্ষার জন্য রয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ এবং কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।
কুষ্টিয়ার বাসিন্দা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিম তোহা প্রথম আলোকে বলেন, ঐতিহ্য হারানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক তত্ত্বাবধানে তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেলে এ জেলার শিক্ষাব্যবস্থা আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে। তা ছাড়া এ জেলায় পরিত্যক্ত মোহিনী মিলের স্থানে একটি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাড়াদি কৃষি ফার্মের জায়গায় একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।
চালের খ্যাতি
ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শহরসংলগ্ন খাজানগর এলাকায় প্রায় ১৫ কোটি টাকার চাল বিক্রি হয়ে যায়। চলে যায় দেশের বিভিন্ন জেলায়। কুষ্টিয়া তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখা এ ব্যবসায় যেমন আছে লাভ, তেমন আছে লোকসান।
১৯৭৮ সালে এ খাজানগর এলাকায় কয়েকটি পরিবার মাটির চাতালে গড়ে তোলে কারখানা। ধীরে ধীরে এ চাতালকল ছড়িয়ে পড়ে সাত কিলোমিটারজুড়ে। সেখানে প্রায় ৪৫০টি ছোট–বড় কারখানা রয়েছে। ১৯৯৭ সালে সেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক ও কর্মচারী যাঁদের অধিকাংশই এ অঞ্চলের বাসিন্দা। একদিকে বেকার সমস্যার সমাধান, অন্যদিকে দেশে ভালো মানের চাল সরবরাহে ভূমিকা রাখছে এসব চালকল।
মিলমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান বলেন, খাজানগরের চালের মান ভালো। এ শিল্পকে আরও উন্নত করতে প্রণোদনার প্রয়োজন।
কুষ্টিয়া নাগরিক কমিটির সভাপতি চিকিৎসক অধ্যাপক এস এম মুসতানজিদ বলেন, এটা সত্য, কয়েক বছর ধরে শহরে যানজট বেড়েছে এবং সড়কগুলো ভাঙাচোরা। তবে কুষ্টিয়াকে নান্দনিকভাবে গড়ে তোলার সব রকম সুযোগ রয়েছে। এর আরও আধুনিকায়ন হওয়া প্রয়োজন। এ শহরে মানুষ বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সবারই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।