সংস্কৃতির মোড় ফেরা, সংস্কৃতির বদলে যাওয়া

সংস্কৃতি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের যে সমস্যাটা প্রথমেই মোকাবিলা করতে হয়, তা হচ্ছে এর সংজ্ঞাগত অনির্দিষ্টতা। সংস্কৃতি যদি একটি জীবনচর্চা হয়, যাতে একটি সমাজের ভাষা থেকে নিয়ে ধর্ম, পারিবারিক ও সামাজিক নানা কৃত্য, আচার এবং উত্সব, নান্দনিক এবং নৈতিক চিন্তাভাবনা ও চর্চা এবং বৃহৎ একটি পরিপ্রেক্ষিতে এর নিত্যদিনতা—এর দৈনন্দিন জীবনযাপন—গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে—কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে এসবের সম্মিলিত রূপটিকে কীভাবে একটা চাদর-সংজ্ঞার নিচে নিয়ে আসা যায়? দুটি সংখ্যা যদি ধ্রুব হয়, অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে তাদের যোগফল হয় একটি স্থির সংখ্যা। কিন্তু সংস্কৃতির উপাদানগুলো ক্রমাগত বদলায়, তাদের লয়-বৃদ্ধি হয়, সময়ান্তরে নতুন নতুন উপাদান সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়। ফলে একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় সংস্কৃতির পরিবর্তনশীল ভুবনটির প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব নয়, এর অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করাও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া সংস্কৃতির সাংস্কৃতিক-নান্দনিক প্রকাশের বাইরে এর একটা রাজনীতিও আছে, এর শ্রেণি চরিত্র আছে, কুলীন-নিম্নবর্গীয় বিভাজন আছে, এর ভেতর স্বতঃস্ফূর্ততার পাশাপাশি আরোপের অনেক বিষয় আছে, এর আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সংযুক্তি আছে। আধুনিকতার শুরু থেকে পুঁজি ও প্রযুক্তি নামের যে দুই শুক্তি একই সঙ্গে এর গতিশীলতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতা নির্ধারণ করে দিচ্ছে, যাদের নিত্যনতুন পরিবর্তন ও উদ্ভাবন সংস্কৃতির বিকাশ এবং ক্ষেত্র বিশেষে এর বিনাশের পেছনে ক্রিয়াশীল, তাদের প্রভাবটাকেও হিসাবে রাখতে হয়।

সংস্কৃতির দুটি আভিধানিক সংজ্ঞা দিয়েই আলোচনাটি শুরু করা যাক। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের সম্পাদনা ও সংকলনে সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (কলিকাতা ১৯৮৮)-এ সংস্কৃতি শীর্ষক ভুক্তিতে বলা হয়েছে ‘সংস্কার; বিশুদ্ধীকরণ...অনুশীলন-লব্ধ দেহ-মন-হৃদয় ও আত্মার উত্কর্ষ; কৃষ্টি’। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে ‘কালচার’ বা সংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞাটি এ রকম, ‘মন, রুচি ও আচরণের প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন এবং শুদ্ধিকরণ; এভাবে প্রশিক্ষিত ও পরিশুদ্ধ হওয়ার অবস্থা; সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক দিক।’ প্রথম সংজ্ঞাটির পরিপ্রেক্ষিত এই উপমহাদেশ, বিশেষ করে বাঙালি সমাজ; দ্বিতীয়টির পশ্চিমের নানা দেশ ও সমাজ। প্রথমটিতে হৃদয় এবং আত্মা কথা দুটি আছে, দ্বিতীয়টিতে নেই; প্রথমটিতে বুদ্ধিবৃত্তিকে গণ্য করা হয়নি, দ্বিতীয়টিতে বুদ্ধিবৃত্তিকে সংস্কৃতি ও সভ্যতার একটি অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে। এ দুটি সংজ্ঞাই বলে দেয়, সংস্কৃতিকে পরিশুদ্ধতার সমান্তরাল বিবেচনা করা হলেও আমরা যেখানে রোমান্টিকতা এবং আধ্যাত্মিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছি, পশ্চিমে আধ্যাত্মিকতাকে আমলে না এনে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভূগোলের এ দুই প্রান্ত থেকে আরও কিছু সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করলে নিশ্চয় সাদৃশ্য-পার্থক্যের তালিকাটা বড় হতো, কিন্তু মোটাদাগে যে দুই প্রবণতার কথা ওপরের দুটি সংজ্ঞায় দেখা যায়, তাদের স্থানচ্যুতির সম্ভাবনা নেই।

সংজ্ঞা দুটি আরেকটু তলিয়ে দেখলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হবে, তা শুরু থেকে আমাদের এই সময় পর্যন্ত সমানভাবে প্রাসঙ্গিক: এই যে অনুশীলন, প্রশিক্ষণ, শুদ্ধিকরণ ও বুদ্ধিবৃত্তির কথা বলা হলো, এগুলো কারা নির্ধারণ করে? এগুলোর মান, ওপর-নিচ মাত্রা, সংজ্ঞা—এসব কে নির্দিষ্ট করে? প্রশিক্ষণ-অনুশীলন যদি ব্যক্তিই শেষ পর্যন্ত করেন, তার পদ্ধতি কি তিনি নির্ধারণ করবেন, নাকি অন্য কোনো ব্যক্তি, সমষ্টি বা প্রতিষ্ঠান তা করে দেবে? ‘আত্মার উত্কর্ষ’ একান্তই ব্যক্তিগত একটি বিষয়; একজনের আত্মা তার সবচেয়ে নিকটাত্মীয়েরও অগোচরে থাকে। এখন কোনো প্রতিষ্ঠান যদি আত্মার উত্কর্ষের দায় নেয়, তাহলে কীভাবে সেটি হয়? আত্মার উত্কর্ষের অনুশীলন যদি সামষ্টিক হয়, তাহলে ধরে নিতে হয় সবার আত্মার রূপ এক। তাহলে এই শুদ্ধিকরণ তো নিপাতনে সিদ্ধের বর্গে পড়ে যায়।

সংস্কৃতির নানা প্রকাশ আছে, এর একটি হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত—যাকে সহজিয়া বলা যায়, যদি এই শব্দটিকে বিশেষ এক সাধক-সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত না করে ব্যবহার করা হয় (ওই সাধক সম্প্রদায়ও তাদের মতো করে স্বতঃস্ফূর্ততার চর্চা করেন)। এই স্বতঃস্ফূর্ততা রয়েছে লোকজ সংস্কৃতির মূলে। এই প্রকাশ কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের অনুশীলন বা প্রশিক্ষণ নির্দিষ্ট করে দেয় না, বরং ব্যক্তি তার জীবনচর্চায় অন্তরঙ্গ আবহে তা ধারণ করে। এবং অনেক ব্যক্তি একই রকম স্বতঃস্ফূর্ততায় তা করলে তার একটি সামষ্টিক রূপ দেখা দেয়, তবে তা হয় বাহ্য, যেহেতু প্রত্যেকের স্বতঃস্ফূর্তটা ভিন্ন। অনেকের মধ্যে আবার স্বতঃস্ফূর্ততার দেখা মেলে না। সংস্কৃতির অন্য প্রকাশটি শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, নান্দনিকতার পরিশীলিত মেজাজ, নৈতিকতার মাপ মেনে চলে। পুঁজির প্রসার শুরু হলে, শিল্পায়ন গতি পেলে, নগরের পত্তন হলে, শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে দাঁড়ালে এই সংস্কৃতির সূত্রপাত হয় এবং ক্রমে এর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। কারণ, এর সঙ্গে সংযুক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা, বিত্ত (মধ্য থেকে নিয়ে উচ্চ), শ্রেণি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা, ক্ষমতা। এই সংস্কৃতি নাগরিক, উচ্চ, শুদ্ধ ইত্যাদি নানা পরিচয়ে পরিচিত। আধুনিকতা এই সংস্কৃতিকে লালন করেছে, আবার এই সংস্কৃতিও আধুনিকতাকে অবলম্বন করেছে। এর ফলে যে দুই শক্তিকে আধুনিকতা অপরিহার্য এবং আসুরিক করেছে—পুঁজি এবং উপনিবেশবাদ—তাদের প্রভাবও নাগরিক বা উচ্চ সংস্কৃতিতে পড়েছে। সংস্কৃতির যে রাজনীতির কথা ওপরে বলা হয়েছে, উচ্চ সংস্কৃতি ক্ষমতার প্রয়োজনে তাকে কাজে লাগায়।

সোজা কথায়, সংস্কৃতি যখন ক্ষমতার স্বার্থ দেখে, তার রাজনীতি হয় দিকনির্দেশনার, বিভাজনের এবং নিয়ন্ত্রণের। ইউরোপের অনেক দেশে একসময় ধর্মের সংস্কৃতি (অথবা গির্জা-নির্ধারিত ধর্মের সংস্কৃতি) ছিল ক্ষমতার পরিপূরক। আধুনিকতা গির্জার প্রাধান্য খর্ব করলে, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসার ঘটলে সংস্কৃতির উচ্চ রূপটি ক্ষমতার সহায়ক হিসেবে আবির্ভূত হলো। ইংরেজরা যখন ভারতে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করল, ইংরেজি ভাষা—ও এর মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতির নানা প্রকাশ—চালুর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদের চর্চাও শুরু করল। পাকিস্তানিরাও ইংরেজদের অনুসরণ করে এ দেশে সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ শুরুর চেষ্টা করেছে। উভয়ের উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় সংস্কৃতিকে দখল করে নেওয়া। পশ্চিমের এখন আর ভৌগোলিক উপনিবেশ নেই, তাদের কোনো উপনিবেশি পাট্টাও নেই (ফকল্যান্ডের মতো দু–এক টংঘর ছাড়া)। এখন উপনিবেশ দূরনিয়ন্ত্রিত, যার প্রধান যন্ত্র পুঁজি। সারা দুনিয়ায় বাজার সৃষ্টি করে, ছোট দেশগুলোর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে এই নয়া পুঁজির উপনিবেশ এখন সর্বত্র। এ জন্য সাংস্কৃতিক উপনিবেশও এখন পুঁজি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে স্থাপিত, বিস্তৃত এবং নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। পশ্চিম এখনো পুবের কাছে তীর্থ, শিক্ষা থেকে নিয়ে বিনোদন—সবকিছুর উত্স।

পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে ধর্মকে ব্যবহার করে আমাদেরকে সংস্কৃতিগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। ইউরোপেও ধর্মের গুরুত্ব চলে গেলে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণে এর প্রয়োগ আর কার্যকর ছিল না। কিন্তু এই উপমহাদেশের দেশগুলোতে এখন ধর্ম গুরুত্ব নিয়ে ফিরেছে—প্রকৃত ধর্ম যতটা, তার থেকে বেশি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। ফলে সংস্কৃতিতে ধর্মের প্রভাব বেড়েছে। আবারও সেই পুরোনো কথায় ফিরে যাওয়া যায়। সংস্কৃতিকে যখন ক্ষমতা তার নিজের কাজে লাগায়, তখন ধর্মকে ব্যবহার করে সংস্কৃতিকে রাজনীতির স্বার্থে লাগানোর বিষয়টা ক্ষমতা মহা আনন্দে করে। এটি এই উপমহাদেশের প্রায় সব দেশে ঘটছে। মিয়ানমারেও ক্ষুদ্র এক মুসলমান জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের জন্য বৌদ্ধধর্মের মতো একটি অহিংস ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কড়া ডানের এখন যে রমরমা অবস্থা, তার পেছনে আছে ধর্মভিত্তিক প্রচারণা। ইউরোপের কোনো কোনো দেশে ধর্মের যে প্রত্যাবর্তন ঘটছে, তার ফলে ডানপন্থী রাজনীতির বিস্তার ঘটছে। ফ্রাঁসোয়া ফরে নামের এক গবেষক তাঁর লেখা রিলিজিয়ন অ্যান্ড পলিটিকস ইন দ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন: দ্য সেক্যুলার ক্যানপি (কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৫) বইয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে ধর্মের ব্যবহার ইউরোপের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে। বইটির শুরুতেই তিনি লিখেছেন, ‘ইউরোপীয় রাজনীতিতে ধর্ম নাটকীয়ভাবে প্রত্যাবর্তন করেছে, যে বিষয়টি এক অবাধ ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রক্রিয়ার ন্যারেটিভগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ ধর্মকে যখন সংস্কৃতির নানা উদারনৈতিক, মাঙ্গলিক, অন্তর্ভুক্তি ও সবার অংশগ্রহণমূরক নানান প্রকাশের বিকল্প হিসেবে অথবা বিপরীতে দাঁড় করানো হয়, তখন সংস্কৃতির শক্তিকে খর্ব করার, একে খোলনলচে বদলে দেওয়ার আয়োজন শুরু হয়। নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে (২৮ অক্টোবর ২০১৮) বলা হয়েছে, সে দেশের ইভানজেলিক সম্প্রদায় নির্বাচনের ধারাটাকেই বদলে দিয়েছে, যার মাধ্যমে ধর্ম ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। এই দক্ষিণপন্থীরা সংস্কৃতিকে তাদের রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহারের জন্য রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়িয়েছে। এখন আমেরিকায় বর্ণবাদ যেভাবে বাড়ছে, তাতে যে উদারনৈতিক সংস্কৃতি একসময় একে প্রতিহত করত, তা ইতিমধ্যে সে দেশের কয়েকটি রাজ্যে দুর্বল হতে শুরু করেছে। একসময় হয়তো তা গুরুত্ব হারাবে।

সংস্কৃতির মোড় ফেরার কথা বলা হয়েছে। এই মোড় ফেরা প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই সময়ান্তরে ঘটে। আমাদের কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সংস্কৃতিতে উপনিবেশি শাসন, শিক্ষার বিস্তার, কৃষিপুঁজির আত্মপ্রকাশ, নগরায়ণ আর শিল্পায়নের প্রভাবে অনেক পরিবর্তন এসেছে; আবার শিক্ষা, নগরায়ণ, শিল্পায়ন ইত্যাদির ফলে সংস্কৃতির নতুন প্রকাশ ঘটেছে। এ দেশে যখন ছাপাখানা এল, তা যে সংস্কৃতিটি নিয়ে এল, তাতে বলার পরিবর্তে লেখার গুরুত্ব বাড়ল। লিখিত সংস্কৃতি, যা মধ্য ও উচ্চবিত্তরা দ্রুত গ্রহণ করল, একসময় কথ্য বা মুখের ভাষার সংস্কৃতির বিপরীতে উচ্চ এবং কুলীন একটি ভাব গ্রহণ করে নাগরিকের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়াল। গ্রামের সংস্কৃতিতে প্রাতিষ্ঠানিকতা অনুপস্থিত, শহুরে সংস্কৃতিতে তা আছে। আর যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা কাঠামোতে কোনো না কোনোভাবে উচ্চ–নিচ বিভাজনটি থাকে, ইংরেজিতে যাকে হায়ারার্কি বলা হয়।

সংস্কৃতির একেবারে শেষ মোড় ফেরার ঘটনাটা সম্পর্কে বলা যাক, যা পশ্চিমে যে রকম আলোড়ন তুলেছে, তেমনই তুলেছে পুবেও—এবং এটি হচ্ছে দৃশ্যমানতার সংস্কৃতি, যার উত্পত্তি ছবি চলমান হতে শুরু করলে। প্রথমে নির্বাক-সবাক চলচ্চিত্র, পরে টেলিভিশন, তারপর ভিডিওগ্রাফি এবং সর্বশেষ কম্পিউটার প্রযুক্তি কুড়ি শতকের শেষ পর্যন্ত এ দৃশ্য—সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়েছে। একুশ শতকে ইন্টারনেট বাহিত তথ্য ও ছবির সর্বগামিতা, ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে নানান ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম (ইউটিউব, টিকটক) এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের (ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম) বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা সংস্কৃতির ভেতর একটা বিস্ফোরণই ঘটিয়ে ফেলল। এর প্রভাব আমাদের সংস্কৃতিতেও পড়েছে। আমাদের সমস্যা হলো, দৃশ্য-সংস্কৃতির একটি প্রযুক্তিও আমরা আবিষ্কার করিনি, তৈরিও করি না, ফলে এর অপব্যবহার রোধ করার সক্ষমতাও আমাদের নেই। তা ছাড়া পশ্চিমে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতিতে এবং ধারাবাহিকতায় এই সর্বশেষ মোড় ফেরার বিষয়টি ঘটেছে, যা আমাদের ক্ষেত্রে কখনো ছিল না। সে জন্য পশ্চিমের সংস্কৃতিতে এ প্রযুক্তিনির্ভর, দৃশ্যশাসিত সংস্কৃতি সেই বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি, যা আমাদের ক্ষেত্রে হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের এক শিক্ষক তিন বছর আগে এটা সমীক্ষার কথা জানিয়েছিলেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে যেসব শিক্ষার্থীর ইন্টারনেটযুক্ত ডিভাইস রয়েছে, তারা প্রতিদিন গড়ে আড়াই ঘণ্টা ফেসবুকে কাটায়। কোভিড অতিমারিতে তা বেড়ে তিন-চার ঘণ্টায় পৌঁছালে আমি অবাক হব না। আমি শুধু ভাবি, এই তিন-চারটি ঘণ্টা যদি পড়াশোনার পেছনে তারা দিতে পারত, তাদের শিক্ষা কত দূর এগোতে পারত।

১৯৬৭ সালে, দৃশ্যমাধ্যমের সুনামি শুরুর অনেক আগে, ফরাসি মার্ক্সবাদী দার্শনিক গি ডিবোর্ড একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম সোসাইটি অব দ্য স্পেকট্যাকল বা চমকের সমাজ। এই চমকের দৃশ্যমান এবং বস্তুগত দুটি রূপই আছে। তিনি দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদ গণযোগাযোগ ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রসারিত হয়ে বস্তুতান্ত্রিকতার পাশাপাশি সামাজিক ও মানুষে-মানুষে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে পণ্যায়ন এখন বিশ্বজনীন, নিউ মিডিয়া এখন আদর্শের জায়গা শাসন করছে এবং প্রকৃত জীবনকে বাদ দিয়ে দৃশ্যসংস্কৃতি তার যে প্রতিরূপ দেখাচ্ছে, তাতেই আমরা মজে গেছি। আমরাও এখন যোগাযোগ ও বিনোদনের শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে ‘কালচার ইন্ডাস্ট্রিজের’ খপ্পরে পড়েছি, যা ক্রমাগত সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করছে। আমাদের চোখ জুড়ে এখন নানা চমক, কখনো তা ব্র্যান্ডচিহ্নিত পণ্যের, কখনো কোনো বিশেষ মতবাদের, কখনো তাক লাগানো কোনো সহিংসতার। ভালোমন্দের বিচারে বিবেক এখন মুখ্য নয়, চাপিয়ে দেওয়া নানা মতবাদই মুখ্য।

এই সময়ে এসে আমাদের সংস্কৃতিতে যে পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান, তাতে যে একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, উত্তরাধুনিকতার ফরাসি দার্শনিক জাঁ বদ্রিয়ারের উদ্ভাবিত একটি শব্দ দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা যায়: শব্দটি ‘সিমুলাক্রাম’। যখন কোনো মূল বিষয়, বস্তু বা চর্চার নকল তৈরি হতে হতে মূলটাই হারিয়ে যায় এবং নকল রাজত্ব করতে থাকে, তখন একে সিমুলাক্রাম বলে অভিহিত করা যায়। প্রতিটি নকল মূলটাকে পাল্টে দেয়, ফলে শেষতম নকলটির সঙ্গে মূলের ব্যবধানটা আর বোঝা যায় না। মূলটা হারিয়ে যায়। কোনটা মৌলিক, কোনটা তার প্রতিলিপি এ পার্থক্যটাও তখন আর নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। বাঙালি সংস্কৃতির মূল রূপটি কি ছিল আমরা জানি না, কিন্তু একসময় কিছু মূল্যবোধ অন্তত তা লালন করত। এখন যে সংস্কৃতি বাংলাদেশের বৃহত্তর সমাজ ধারণ ও চর্চা করছে, তাতে এসবের উপস্থিতি নিতান্তই প্রান্তিক। আমার শৈশবে মা–বাবা, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীকে যেসব মূল্যবোধ ধারণ করতে দেখেছি, যেসব জীবনচর্চা তাদের করতে দেখেছি, এখন সেসবের একটা বড় অভাব দেখতে পাই। আগেই বলেছি, সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল, কিন্তু সংস্কৃতির একেবারে বদলে যাওয়াটা ভিন্ন একটা ব্যাপার। বয়স্কদের সম্মান দেখানো, সৌজন্যবোধের চর্চা, পরার্থপরতা, অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকা, ঘুষ-উৎকোচ থেকে দূরে থাকা, ধর্মটাকে পোশাকে-আস্তিনে বয়ে না বেড়িয়ে হৃদয়ে ধারণ করা, ধর্মের নামে বিভেদ সৃষ্টি না করা, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের নিপীড়ন না করা, নিজের চর্চা অন্যের ওপর চাপিয়ে না দেওয়া, সংবেদনশীল বিষয়ে কোনো বিতর্ক সহিংসতায় সমাধান না করে যুক্তি দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটানো—এসবকে নিশ্চয় কেউ মন্দ বলবেন না। এসবের চর্চা আমি শৈশবে দেখেছি, কিন্তু এখন দেখছি খুবই কম। এখন আমাদের ভাষা বদলে গেছে, অকারণে খিস্তিখেউড় আওড়াচ্ছি, অভব্য হচ্ছি, দুর্নীতি আমাদের গা সওয়া, বস্তুর প্রতি মোহ আমাদের বেড়েছে। আমরা একটা চমকের সমাজ তৈরি করেছি, যাতে মূল থেকে প্রতিরূপটাই বেশি প্রকৃত, অবয়ব থেকে তার ছবিটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখন সর্বত্র অনুকরণ আর প্রদর্শন। যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়ায়, তাদের আমরা শিক্ষাপ্রাপ্ত বলে ধরে নিই। কিন্তু এর এক উল্লেখযোগ্য অংশ যে অশ্লীলতা, বীভত্সতা, সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রতা আর অসহিষ্ণুতার প্রকাশ দেখায়, তাতে বোঝা যায় পুরোনো সংস্কৃতিটা হারিয়ে যাচ্ছে।

দুই.

পয়লা বৈশাখের উদ্‌যাপন সামনে রেখে এই লেখা লিখছি। সংস্কৃতির যে বাঁকবদলের কথা শুরুতে বলা হয়েছে, পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন তারই একটা উদাহরণ। আশির দশকে যখন ঢাকায় এ উত্সব নবায়নকৃত হলো, তখন দৃশ্যমাধ্যমের বিস্তার শুরু হয়েছে। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন তখন অনেকের অভিজ্ঞতার অংশ। মূল পয়লা বৈশাখ, যা গ্রামেগঞ্জে নিভৃতে, সামান্য আয়োজনে, অনাড়ম্বরে উদ্‌যাপিত হতো, এই নবায়নে তাতে বেশ কিছু রং যুক্ত হলো, কিছু নতুন কৃত্যও। শুরুতে এর একটা আবেদন ছিল, প্রয়োজনীয়তাও ছিল, যেহেতু গ্রামীণ উদ্‌যাপনের শহুরে আয়োজনে আমাদের মূলের সাংস্কৃতিক শক্তিটিকে আমরা ধারণ করতে চেয়েছি। সংস্কৃতি তার নিজের প্রয়োজনে একটা বাঁক নিয়েছিল, যার পেছনে একটা অনুপ্রেরণা ছিল দৃশ্য সংস্কৃতির। কিন্তু যত দিন গেল, এ উদ্‌যাপন একটা সিমুলাক্রাম হয়ে দাঁড়াল। মজার বিষয়, এখন অনেক গ্রামেও ঢাকার আদলে নববর্ষের মেলা হয়, লাল–সাদা পোশাকে মানুষজন নববর্ষকে বরণ করে। অর্থাৎ গ্রামের নিভৃত আয়োজনটিতে ছায়া ফেলেছে চমক এবং তাকে বদলেও দিচ্ছে। তারপরও এই উত্সব যেহেতু সর্বজনীন, সে জন্য এর একটা মূল্য আছে। আর উগ্রবাদীরা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলে, নিরাপত্তার যুক্তি তুলে বড় শহরগুলোতে এ উদ্‌যাপনকে সূর্যাস্ত আইনে ফেলে দিলে বোঝা গেল, এর একটা শক্তিও আছে।

এখন বাঙালি সংস্কৃতিকে শহরের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে, সামাজিক অনেক কৃত্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংস্কৃতি যেসব মূল্যবোধ একসময় শেখাত, এখনো শেখানোর চেষ্টা করে, সেগুলোও ক্রমশ বিলীয়মান। গত ষাট-সত্তর বছর আগে বাঙালি মুসলমান যে সংস্কৃতির চর্চা করত, তা এখন পরিত্যাজ্য। আগামী ত্রিশ-চল্লিশ বছর পর ভিনদেশের কেউ বাংলাদেশে বেড়াতে এলে যে সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতি হবেন, তাকে কোন সংস্কৃতি বলা যাবে?

তার ভিত্তিমূল রচনা করবে, অর্থাৎ করার কথা, যেসব মূল্যবোধের, সেগুলোই–বা কী হবে? প্রতিদিনতার চিত্রটা কী হবে?

কে জানে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক