সচিবের সিদ্ধান্তে নতুন ঝুঁকিতে সুন্দরবন
>
- ৩০০ অটো গ্যাস স্টেশনের অনুমোদন।
- প্রতিমন্ত্রীকে না জানিয়ে অনুমোদন দিয়েছেন সচিব।
- বিপিসির আপত্তি ছিল।
- সুন্দরবনের দূষণঝুঁকি বাড়বে

নিয়ম না মেনে সারা দেশে যানবাহনের জ্বালানির জন্য ৩০০ অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপন এবং সেখানে এলপি গ্যাস সরবরাহে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এনার্জিপ্যাককে অনুমোদন দিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের সচিব। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের আরও কাছে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটির স্থাপনা থেকে এই গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এই স্থাপনায় এলপি গ্যাস আমদানির ফলে সুন্দরবনের ভেতরে জাহাজ চলাচল বেড়ে যাবে। এতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন আরও দূষণঝুঁকির মুখে পড়বে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এনার্জিপ্যাককে অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপন এবং সেখানে গ্যাস সরবরাহের অনুমোদনে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আপত্তি ছিল। এমনকি এই অনুমোদনে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সইও ছিল না। বিধি না মেনে এককভাবে এ অনুমতি দিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী।
প্রতিমন্ত্রীর স্বাক্ষর না নিয়ে নথি অনুমোদনের বিষয়ে জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গতকাল মঙ্গলবার নাজিমউদ্দিন চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। এরপর খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি।
এনার্জিপ্যাক জি-গ্যাস নামে বাজারে বোতলজাত এলপি গ্যাস বিক্রি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির এলপি গ্যাসের স্থাপনাটি খুলনার দাকোপের চুনকুটিতে সুন্দরবনের পাশে অবস্থিত। এলপি গ্যাস ছাড়াও এনার্জিপ্যাকের বিদ্যুৎ খাতে ব্যবসা রয়েছে। তরল পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস বাংলাদেশে মূলত বাসাবাড়ি বা হোটেল-রেস্তোরাঁয় রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। অটো গ্যাস নামে পরিচিত এ জ্বালানি দিয়ে বর্তমানে যানবাহন চলছে। এর বাইরে বর্তমানে সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজি দিয়েও যানবাহন চলছে।
অনুমোদন সম্পর্কে এনার্জিপ্যাক ও জি-গ্যাসের পরিচালক রিজুয়ানুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের অটো গ্যাসের অনুমতি যাতে দ্রুত হয়, সে কারণে জ্বালানি বিভাগের সচিব এভাবে ব্যবস্থা নিয়েছেন। এটি করা হয়েছে যাতে প্রকল্পটি দ্রুত করা যায়।’
যেভাবে অনুমোদন পেল এনার্জিপ্যাক
অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপন ও সরবরাহের জন্য আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে প্রথমে জ্বালানি বিভাগে আবেদন করতে হয়। সেখান থেকে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করার জন্য বিপিসি ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের পাঠানো হয়।
নিয়ম অনুযায়ী আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান যেসব স্থানে অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপন করতে চায়, সেই জমিরও মানচিত্র এবং জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও বিপিসি ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরে জমা দিতে হয়। বিপিসি ও বিস্ফোরক পরিদপ্তর সরেজমিনে সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দেয় জ্বালানি বিভাগে। এর পর জ্বালানি বিভাগ বোতলজাত এলপি গ্যাসের স্থাপনা ও অটো গ্যাস স্থাপনের প্রাথমিক অনুমতি দিয়ে থাকে। আর তাতে সম্মতি থাকতে হয় সচিব ও প্রতিমন্ত্রীর। কিন্তু এনার্জিপ্যাককে সারা দেশে ৩০০ অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপন এবং সেখানে গ্যাস সরবরাহের অনুমোদন দিতে জ্বালানিসচিব নিয়মের সব ধাপই ভেঙেছেন। বিপিসির আপত্তি ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সই ছাড়াই এই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে অনুপস্থিত দেখিয়ে জ্বালানি বিভাগের সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী গত ১৪ জানুয়ারি এনার্জিপ্যাককে ৩০০ অটো গ্যাস স্থাপনের অনুমতি দেন। প্রতিমন্ত্রী দেশে ফেরার পর তাঁকে অবগত করা হবে বলে অনুমোদনের নথিতে উল্লেখ করা হয়। প্রতিমন্ত্রী বিদেশ থেকে ফিরে গত ২২ জানুয়ারি এনার্জিপ্যাকের অটো গ্যাস স্টেশনের অনুমতি না দিয়ে এ ধরনের অনুমোদনের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নথি উপস্থাপন করার বাধ্যবাধকতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

এর আগে বিপিসি এনার্জিপ্যাককে অটো গ্যাস স্থাপনের প্রাথমিক অনুমোদন না দেওয়ার জন্য চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল। তবে তাতে সায় দেননি জ্বালানি বিভাগের সচিব। গত ১ জানুয়ারি বিপিসির চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম স্বাক্ষরিত জ্বালানি বিভাগে লেখা চিঠিতে বলা হয়, এলপি গ্যাস অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালার শর্ত পূরণ ছাড়া এনার্জিপ্যাককে অটো গ্যাস স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হলে আরও প্রতিষ্ঠানকেই তা দিতে হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, এনার্জিপ্যাক এলপিজি বোতলজাত প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য ২০১২ সালে জ্বালানি বিভাগের প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছিল। দুই বছরের মধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়ার কথা থাকলেও তারা এখন পর্যন্ত তা নেয়নি। নিয়ম থাকলেও তারা বিপিসির সঙ্গে এখনো চুক্তি করেনি। এনার্জিপ্যাক এলপিজির অপারেটর হিসেবে শর্ত ভেঙেছে। এ মুহূর্তে এনার্জিপ্যাককে অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপনের অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ নেই।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিপিসির এ রকম প্রতিবেদন পাওয়ার পর সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী একক কর্তৃত্বে এনার্জিপ্যাকের অনুমোদনের নথি উত্থাপনের মৌখিক নির্দেশ দেন। মৌখিক নির্দেশের তথ্য নথিতেও উল্লেখ করা হয়েছে। বিপিসির আপত্তি আমলে না নিয়ে সচিব গত ১৪ জানুয়ারি এনার্জিপ্যাককে দেশজুড়ে ৩০০টি অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপনের অনুমতি দিয়ে সই করেন। অনুমতি পাওয়ার পর এনার্জিপ্যাক অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপনের কাজ শুরু করেছে।
সরকারের একাধিক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব অনুমোদন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী পর্যায়ের, সেসব বিষয়ে তাঁদের এড়িয়ে শুধু সচিব এককভাবে অনুমতি দিতে পারেন না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অনুশাসন রয়েছে। মন্ত্রী বিদেশে রয়েছেন, তিনি ফিরলে অবগত করা হবে—এমন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় সাধারণত দুর্নীতির সহজ পথ বেছে নেওয়ার জন্য। কারণ, অনেক সিদ্ধান্ত রয়েছে যেখানে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীরা একমত না-ও হতে পারেন।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এনার্জিপ্যাকের ৩০০ অটো গ্যাস স্টেশনের অনুমতি দিইনি। আমার অনুপস্থিতিতে এই নথি অনুমোদনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু সেটিও হয়নি। আমি দেশে ফিরে এসেও এ নথিতে অনুমোদন দিইনি। এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না ঘটে, সে জন্য ভবিষ্যতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়ার জন্য বলেছি।’
সুন্দরবনের দূষণঝুঁকি বাড়বে
সুন্দরবন থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূরত্ব মাত্র ১৪ কিলোমিটার। আর সুন্দরবন থেকে এনার্জিপ্যাক এলপি গ্যাসের প্ল্যান্টের দূরত্ব আরও কম, মাত্র সাড়ে ১১ কিলোমিটার। এনার্জিপ্যাকের জি-গ্যাস নামে প্ল্যান্টটি খুলনার সুন্দরবন এলাকায় দাকোপ উপজেলার চুনকুটিতে। পশুর নদের যে পথটি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হবে, সেই একই পথ এনার্জিপ্যাকের প্ল্যান্টের এলপি গ্যাস আমদানির জন্যও ব্যবহৃত হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো জ্বালানি ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হলে ওই প্রকল্পের জন্য একটি পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করতে হয়। আলাদা একটি পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হয় এর পণ্য পরিবহন ও এর পথ নিয়েও। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহন ও সঞ্চালন লাইনের জন্য আলাদা ইআইএ করা হয়েছে। কিন্তু এনার্জিপ্যাকের এই প্রকল্পের জন্য এ ধরনের কোনো ইআইএ করা হয়নি বলে পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পরিবহনের কারণে সুন্দরবনের ভেতর জাহাজ চলাচল এমনিতেই বাড়বে। তাতে বিশ্বের বৃহত্তম এ শ্বাসমূলীয় বন বহুমাত্রিক ঝুঁকিতে পড়বে বলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক উদ্বেগ আছে। এরই মধ্যে আবার সারা দেশের ৩০০ অটো গ্যাস স্টেশনের জ্বালানি এলপি গ্যাস যাবে খুলনার দাকোপে এনার্জিপ্যাকের স্থাপনা থেকে। এই বিশাল জ্বালানির জোগান সরবরাহ নিশ্চিত করতে এই স্থাপনায় এলপি গ্যাস বেশি করে আমদানি করতে হবে। এতে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল আরও বাড়বে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এনার্জিপ্যাকের জাহাজ চলাচল পুঞ্জীভূত দূষণ বাড়াবে সুন্দরবনে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, এটা তো স্পষ্টতই অনিয়ম। নিয়মবহির্ভূতভাবে জ্বালানি বিভাগের সচিব কীভাবে এই অনুমোদন দিলেন, তা খতিয়ে দেখতে হবে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীকে। বিধিবহির্ভূত অনুমোদন দেওয়ায় আইনের আওতায় আনতে হবে সচিবকে। তিনি বলেন, সুন্দরবনের কাছে এ ধরনের স্থাপনা এখনই বন্ধ করতে হবে। এটি এখনই বন্ধ না করলে সুন্দরবনের প্রভূত ক্ষতি হবে।