সন্তানের যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে অভিভাবককে সচেতন হতে হবে

নবম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী বলে, ‘যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তাম তখন একদিন শিক্ষকের কাছে ঋতুস্রাব ও স্বপ্নদোষ কাকে বলে জানতে চাই। শিক্ষক থতমত খেয়ে যান। ক্লাসের অন্যরা হাসাহাসি করতে থাকে। আমার কি দোষ? বইতে যা লেখা ছিল বুঝতে পারি নাই, তাই জানতে চাইছিলাম।’ 

আরেক শিক্ষার্থী বলে, ‘যখন পিরিয়ড হয় মার কাছে জানতে চাই। মা বলে, এইটা গোপন কথা। বাইরের কেউ যেন না জানে। তখনই থমকে গেলাম।’
মাদ্রাসার এক ছেলে শিক্ষার্থী বলে, ‘স্বপ্ন দোষ হলে শিক্ষক তো দূরের কথা, বন্ধুদের কাছেও কিছু বলতে পারি নাই।’ এই শিক্ষার্থী জানায়, শিক্ষকেরা বলতেন, শিক্ষার্থীরা যাতে বাড়ি থেকে পড়ে আসে।
মাদ্রাসার আরেকজন শিক্ষার্থী বলে, ‘স্বপ্ন দোষ হইলে বাবা, মা শিক্ষক কারও কাছে কিছু বলতে না পেরে কাছের হাসপাতালে এক ডাক্তারের কাছে যাই। ওই ডাক্তার গুরুত্ব দিয়া আমার কথা না শুনেই বলে, ভালো করে পড়ালেখা কর, সব ঠিক হয়ে যাব।’
আজ শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বেসরকারি সংগঠন নারীপক্ষ আয়োজিত ‘কিশোর-কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার: প্রেক্ষিত জাতীয় শিক্ষা পাঠ্যক্রম’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এভাবেই তাদের অভিজ্ঞতা বলছিল।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার শিক্ষকেরাও বললেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। একজন বললেন, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা কথা বললে অনেক সময় অন্য শিক্ষকেরা হাসাহাসি করেন। সভায় কোনো কোনো শিক্ষক এই সব কথা এত খোলামেলাভাবে বললে তা হিতে বিপরীত হতে পারে বলেও সতর্ক করলেন। অনেকের সুপারিশ ছিল, ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা ক্লাসে যাতে এই সব পড়ানো হয়। এ ছাড়া অভিভাবকদের সচেতন করার বিষয়টিও গুরুত্ব পায়।
নারীপক্ষ নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন ক্ষেত্র নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে করে। সভার শুরুতে মালয়েশিয়ার নারী সংগঠন এশিয়ান প্যাসিফিক রিসোর্স অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ফর উইমেন এর সহায়তায় প্রকল্পের অধীনে করা এক গুণগত গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন নারীপক্ষের সদস্য কামরুন নাহার। এতে ঢাকা মহানগরীর ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বাংলা ও মাদ্রাসা শিক্ষা) ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির সর্বমোট ১২০ জন শিক্ষার্থী, ২০ জন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক এবং ২৫ জন বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ও অভিভাবকদের মতামত নেওয়া হয়।
মতবিনিময় সভায় শিক্ষক শিক্ষার্থীরা যে ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলে, গবেষণায় অংশ নেওয়াদের কাছ থেকেও কাছাকাছি মন্তব্য পাওয়া যায়। গবেষণায় উঠে আসে, ২০১৩ সালে পাঠ্যসূচি থেকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের অনেক বিষয় বাদ দেওয়া হয়।
মতবিনিময় সভার প্রধান অতিথি জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দ্বাদশ শ্রেণিতেও কিছু কিছু বিষয় আছে। শিক্ষাক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া, জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে তা পরিমার্জন করা হবে। তবে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ের ক্লাসগুলো আলাদা নেওয়ার বিপক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, এতে করে ছেলেরা মেয়েদের এবং মেয়েরা ছেলেদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে না। এ চ্যালেঞ্জ উত্তরণ করতে হবে।
এনসিটিবির সদস্য রতন সিদ্দিকী বলেন, এনসিটিবির বর্তমান পলিসি হচ্ছে, পাঠ্যপুস্তকে যা দেওয়া হয়েছে তা থাকুক। পাঠ্যপুস্তকে দিয়ে শুধু শিক্ষকদের পড়াতে বললেই হবে না, সমাজকেও তা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিতে জোর দেওয়া হচ্ছে।
মতবিনিময় সভায় সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন নারীপক্ষের সদস্য ইউ এম হাবিবুন নেসা।