সন্তান যেন মা-বাবার কাছে থাকে দুধে-ভাতে

শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা

বছর দশেক আগের কথা। রাজধানীতে এক মা তাঁর দুই শিশুসন্তানকে বাড়ির ছাদে নিয়ে গিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে নিজের গায়েও আগুন লাগান।

ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিশু দুটি মারা যায়। দগ্ধ মাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।

সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে ঘটনার পরদিন ফলোআপ প্রতিবেদনের জন্য গেলাম বার্ন ইউনিটে।

সংবাদমাধ্যমে শিশু দুটির দাদার বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল। দগ্ধ অবস্থায় শিশু দুটি দাদার কাছে জানতে চেয়েছিল, মা কেন তাদের গায়ে আগুন দিল?

এ প্রশ্নের জবাব না শুনেই শিশু দুটিকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।

পরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, বাবা অন্য এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন। এ নিয়ে সংসারে অশান্তি চলছিল। একপর্যায়ে ক্ষোভ থেকে মা এ কাজ করেন।

শেষ পর্যন্ত ওই নারীরও মৃত্যু হয়। পেশাগত প্রয়োজনে সে সময় ওই নারীর বড় ভাইয়ের সঙ্গে বেশ কয়েক দিন যোগাযোগ হয়। তিনি আফসোস করে বলেছিলেন, দুই পরিবারের পক্ষ থেকে একটা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। তাঁর বোন যে রাগ-ক্ষোভ-অভিমান থেকে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেবেন, তা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি।

ওই নারীর ভাইয়ের আফসোস আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। ভাবছিলাম, স্বামীকে ‘শায়েস্তা’ করতে স্ত্রী যে কাজটি করলেন, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

একই ধরনের আরেকটি সমসাময়িক ঘটনার কথা মনে পড়ে। রাজধানীতে ৮-১০ বছরের দুই সন্তানকে নিয়ে বিষ খেয়ে এক মা ‘আত্মহত্যা’ করেছিলেন। এ ঘটনার পেছনে ছিল অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক, পরে দ্বিতীয় বিয়ে। বাড়ির দেয়ালজুড়ে লেখা ছিল তিনজনের ক্ষোভের কথা।

এমন ঘটনার আরও উদাহরণ পাওয়া যায়। ২০০৮ সালে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায় স্ত্রীসহ দুই শিশুসন্তানকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগ ওঠে স্বামীর বিরুদ্ধে। প্রতিবেশী নারীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে এ ঘটনা ঘটে বলে তখন খবর বের হয়।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক মেয়েশিশুর লাশ পাওয়া যায়। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, শিশুটির মায়ের সঙ্গে অন্য এক পুরুষের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ছিল। এ সম্পর্ককে ‘কণ্টকমুক্ত’ করতে শিশুটিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন দুজন। পরিকল্পনা অনুযায়ী শিশুটিকে চিকিৎসক দেখাতে হাসপাতালে নিয়ে যান মা। পরে শিশুটিকে হাসপাতালের একটি ভবনের সিঁড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন ওই পুরুষ।

সাম্প্রতিক এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পেছনের এত সব কথা মনে পড়ল। এবারের ঘটনাস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলা। পুলিশের ভাষ্যমতে, ১০ মার্চ আশুগঞ্জ উপজেলায় এক নারী বিষ মেশানো মিষ্টি খাইয়ে তাঁর দুই শিশুসন্তানকে হত্যা করেছেন। অপর এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে এ ঘটনা ঘটান তিনি।

মামলার সবশেষ অবস্থা জানতে আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ রহমানকে ফোন করি। তিনি জানান, শিশুদের মা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কে থাকা পুরুষ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

এমন সব ঘটনার যে সংবাদ সামনে আসে, তা বিশ্লেষণে দেখা যায়, পারিবারিক অশান্তি, স্বামী বা স্ত্রীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, মান-অভিমান, ক্ষোভ প্রভৃতির শিকার হয় অবুঝ সন্তানেরা।

মা-বাবাকে সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গণ্য করা হয়। কখনো কখনো সেই মা-বাবা যখন সন্তানের হন্তারক হয়ে ওঠেন, তখন আমাদের পরিবার প্রথা ও রক্তের সম্পর্কের ধারণা মারাত্মকভাবে ধাক্কা খায়। আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। মনে প্রশ্ন জাগে, এমন কেন হয়?

মনোবিজ্ঞানে ‘ইড’ বলে একটি শব্দ আছে। এই ‘ইড’ হচ্ছে ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে মৌলিক অংশ। এটা আমাদের পশুপ্রবৃত্তিরও প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন খাবার ও যৌনতার আকাঙ্ক্ষা। আমাদের সব রকমের চাহিদা, কামনা, বাসনার তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টি খোঁজে ‘ইড’। এগুলো না মিললে ব্যক্তির মধ্যে তীব্র তাড়নার সৃষ্টি হয়। এ তাড়না থেকেই ঘটে নানা বিপত্তি।

‘ইড’ কীভাবে কাজ করে, আর সবাই একই রকম আচরণ কেন করে না, তার ব্যাখ্যা জানতে যোগাযোগ করি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রত্যেকের মধ্যে কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা বা পাশবিক প্রবৃত্তি (ইড) থাকে। আমরা ‘ইড’ নিয়ন্ত্রণ করি ‘সুপার ইগো’ দিয়ে। ‘সুপার ইগো’ কামনা-বাসনাকে দূরে সরিয়ে রাখে। আর এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে ‘ইগো’। সামাজিক সংস্কার, সভ্যতা ও শিক্ষা দিয়ে মানুষ ‘ইড’ নিয়ন্ত্রণ করে। কখনো কখনো মানুষ ‘ইড’ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে নানা ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা ঘটায়।

হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এ ধরনের অপরাধে যেন কেউ না জড়ায়, সে কারণে শৈশব থেকেই ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। এ ধরনের সংবাদ পরিবেশনেও সংবেদনশীল হতে হবে। এটা যে অপরাধমূলক, ব্যতিক্রম ও অস্বাভাবিক ঘটনা, তার ব্যাখ্যা সংবাদে থাকতে হবে, যেন লোকজন এ ধরনের অপরাধে না জড়ায়।

আসুন, আমরা আমাদের ‘সুপার ইগো’ দিয়ে ‘ইড’ নিয়ন্ত্রণ করি। নিজেদের চাহিদা, কামনা, বাসনা, ক্ষোভ, জেদকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে সন্তানদের বলি না বানাই। সন্তান যেন ‍মা-বাবার কাছে থাকে দুধে-ভাতে।