সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভর্তুকি

সঞ্চালন লাইন না থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতার অর্ধেক কাজে লাগছে। মাসে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা।

পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে গত বছর। এটি এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বেশি উৎপাদনক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র। সম্প্রতি তোলা
ছবি: বিসিপিসিএলের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছে, কিন্তু সঞ্চালন লাইন নির্মাণ বাকি। ফল হলো, কেন্দ্রটি পুরো সক্ষমতায় চালানো যাচ্ছে না। বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দিতে হচ্ছে।

এ ঘটনা দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পটুয়াখালীর পায়রায়। পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুই ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ। প্রতি ইউনিটের উৎপাদনক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট, মোট ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। গত বছরের মে মাসে একটি ইউনিটে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। গত ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসে দ্বিতীয় ইউনিট। তবে দুই ইউনিট পুরো সক্ষমতায় চালানো যায় না। কারণ, দুই ইউনিটে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তা সঞ্চালন করার মতো লাইন নেই।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পায়রার বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ চলছে। রাজধানীর আমিনবাজার থেকে মাওয়া-গোপালগঞ্জ হয়ে বাগেরহাটের মোংলা পর্যন্ত ৪০০ কিলোভোল্টের (কেভি) সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ শেষ হলে পায়রার বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়া যাবে। তার আগপর্যন্ত পুরো সক্ষমতায় পায়রার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো সম্ভব নয়।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি আগামী বছর লাইন নির্মাণের কাজ শেষ হবে। করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। যত দিন বিদ্যুৎ নিতে না পারব, তত দিন আমাদের ক্যাপাসিটি চার্জ (বসিয়ে ভাড়া) দিতে হবে।’

নসরুল হামিদ বলেন, যে ঠিকাদারকে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজটি দেওয়া হয়েছিল, তারা দেরি করেছে। সে জন্য তাদের বাদ দিয়ে নতুন করে চায়না মেশিনারিজ কোম্পানিকে (সিএমসি) ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

২১ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎকেন্দ্র

সরকারের পরিকল্পনায় থাকা বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত উৎপাদনে এসেছে পায়রা। ২০১৪ সালে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ও চায়না মেশিনারিজ কোম্পানির (সিএমসি) মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। চুক্তির আওতায় দুই কোম্পানি যৌথভাবে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) প্রতিষ্ঠা করে, যার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।

পায়রা চালু হওয়ার আগে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটের মেঘনা পাওয়ার লিমিটেড (এমপিএল)। এর উৎপাদনক্ষমতা ৪৫০ মেগাওয়াট। নির্মাণকাজ চলতে থাকা রামপাল কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়াবে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে এই কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে।

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে জাপানি অর্থায়নে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে। এটি নির্মাণ করছে সরকারি সংস্থা কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি।

অলস কেন্দ্রে ভর্তুকি

সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণে এমনভাবে চুক্তি করে যে সেগুলো বসে থাকলে মাসে মাসে ভাড়া দিতে হয়। এটাকে বলা হচ্ছে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’। পায়রার পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারায় প্রতি মাসে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানিকে ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ১০০ কোটি টাকার মধ্যে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিবি) ২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। কারণ, তারা নির্ধারিত সময়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে পারেনি।

বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভাড়া দেওয়ার ঘটনা শুধু এটা নয়। কয়েক বছর ধরেই দেশে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা অনেক বেশি। ফলে যেসব কেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা কাজে লাগে না, সেগুলোকে ভর্তুকি দিতে হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) গত বছর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যবহার করা হয়, বাকি ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, অলস কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।

বিদ্যুৎ বিভাগের গত ১০ জুনের হিসাব অনুযায়ী, সরকারি, বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগে দেশে মোট ১৪৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ৫৭, বেসরকারি ৯১ ও ১টি যৌথ উদ্যোগের। বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি (ক্যাপটিভ ও অফ-গ্রিড নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাদে)। প্রকৃত সক্ষমতা ২১ হাজার মেগাওয়াটের মতো। বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৩ হাজার মেগাওয়াটের আশপাশে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত জুনে এক প্রতিবেদনে মে মাসের এক দিনের হিসাব তুলে ধরে জানিয়েছিল, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে। অলস কেন্দ্রগুলোকে ভর্তুকি দিতে গিয়ে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও বিভিন্ন সংস্থাকে ঋণ দেওয়ার জন্য ৪৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ভর্তুকিতে কৃষির পরে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিদ্যুৎ খাত। এই খাতে চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি বরাদ্দ ৯ হাজার কোটি টাকা।

সঞ্চালন লাইন কত দূর

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানা গেছে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তা সরাসরি চলে যায় গোপালগঞ্জে। সেখান থেকে বিতরণ হয় তাদের সাবস্টেশনে। মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পর্যন্ত এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক গোলাম মাওলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কখনো প্রথম ইউনিট চালু রাখি। কখনো দ্বিতীয় ইউনিট চালাই। এটা তো যন্ত্র। বসিয়ে রাখা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘যত বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, তত বেশি যন্ত্রপাতির সক্ষমতা বাড়ে। বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হলে যন্ত্রপাতির সক্ষমতা কমে যায়।’

রাজধানীর আমিনবাজার থেকে মাওয়া-গোপালগঞ্জ হয়ে মোংলা পর্যন্ত যে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ চলছে, তা শেষ হলে পায়রার বিদ্যুৎ ঢাকায় আনা যাবে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আমিনবাজার থেকে মোংলা পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। গত ডিসেম্বরেই এই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। প্রকল্পে ব্যয়ের পরিমাণ ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা পিজিসিবি জানিয়েছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

যদিও মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা। সঞ্চালন লাইন নির্মাণের অগ্রগতির খবর নিতে গিয়ে জানা যায়, পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে বিদ্যুতের তার নিতে সাতটি টাওয়ার নির্মাণ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই সাত টাওয়ার নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর দুই কিলোমিটারের মধ্যে। আর নদীর দুই পারে দুটি করে টাওয়ার থাকবে। সব মিলিয়ে নির্মাণ করতে হবে ১১টি টাওয়ার। এই টাওয়ারগুলো নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে সেতু বিভাগ।

আমিনবাজার-মাওয়া-মোংলা সঞ্চালন লাইন নির্মাণে পিজিসিবির প্রকল্পের পরিচালক মোরশেদ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেতু বিভাগ টাওয়ার বুঝিয়ে দিলে আমরা পরবর্তী কাজ করতে পারব।’ তিনি বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণেও কাজের গতি শ্লথ হয়ে যায়। তাই চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগও (আইএমইডি) মনে করছে, ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা কঠিন। গত জুনে তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পদ্মার ওপর দিয়ে সঞ্চালন লাইন নিতে টাওয়ার নির্মাণকাজের অগ্রগতি তুলনামূলক কম।

এদিকে আরেকটি সমস্যার কথা জানিয়েছেন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক গোলাম মাওলা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানিতে জটিলতা দেখা দিয়েছে। নদীতে নাব্যতা-সংকটের কারণে প্রায়ই জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।

‘এটা টাকার অপচয়’

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, দেশের সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা গ্যাসভিত্তিক, মোট ক্ষমতার ৫২ শতাংশ। এর বাইরে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রের ক্ষমতা ২৭, ডিজেলের ৬ ও কয়লার ৮ শতাংশ। বাকিটা জলবিদ্যুৎ ও আমদানির বিদ্যুৎ। গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় ৩ টাকার কম। আর কয়লায় ৭ টাকার বেশি। জ্বালানি তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়, প্রতি ইউনিটে ২০ টাকার মতো।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরো সক্ষমতায় চালানো গেলে কম খরচে ৬০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যেত, যা বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ কমাতে ভূমিকা রাখত।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সরকার শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যাচ্ছে। উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদার কোনো সমন্বয় নেই। তিনি বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তা দেশের টাকার অপচয়। এভাবে অপচয় করা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।