সবজির ট্রাকে বাড়তি দিতে হয় ৯২০ টাকা

যশোরের বারীনগর পাইকারি মোকাম থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে সবজি পাঠানো হয়। এই মোকামের সবজি খুচরা পর্যায়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে ভোক্তাকে কিনতে হয়। সবজির দাম কেন এত বাড়ে, তা দেখার জন্য গত রোববার বারীনগর মোকাম থেকে ছয় ধরনের সবজিবোঝাই পাঁচ টনের একটি ট্রাকে উঠে বসেন প্রথম আলোর এই প্রতিনিধি।

১৯ হাজার টাকা ভাড়া ঠিক করার পর ঢাকার কারওয়ান বাজার ও যাত্রাবাড়ী কাঁচা বাজারের উদ্দেশে বেলা একটায় রওনা দেয় ট্রাকটি। ঝিনাইদহ হয়ে মাগুরার ভেতর দিয়ে ট্রাক এগিয়ে চলল। ট্রাকটি গড়াই নদের ওপরে নির্মিত লোহার সেতু যখন পারাপার হয়, তখন বেলা আড়াইটা।

ওরা দালাল। ঘাট ফাঁকা আছে দেখে ফোন দিলেই দ্রুত এগিয়ে যেতে বলল
চালক

সবজির ট্রাক কুমারখালী সেতুর মাগুরা প্রান্তে পৌঁছালে পারাপার হতে ১৭০ টাকা দিতে হয়। ছোট ওই সেতুটি পারাপারে টোলের পরিমাণ ১০০ টাকার বেশি হওয়া উচিত না বলে খেদোক্তি করলেন ট্রাকের চালক।

এর আগে ৫ এপ্রিল এই প্রতিনিধি একইভাবে যশোর থেকে সবজির ট্রাকে চড়ে ঢাকায় এসেছিলেন। এ সময় পথে বিভিন্ন স্থানে দৃশ্যমান ও ‘অদৃশ্য’ চাঁদাবাজি দেখেছেন তিনি। এবার তিনি ফেরিঘাটসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ট্রাকচালককে মোট ৯২০ টাকা চাঁদা দিতে দেখেছেন।

আরও পড়ুন

ঘাটে দালালের খরচ

দৌলতদিয়া–পাটুরিয়া ফেরি পারাপারের জন্য বিকেল চারটায় সবজির ট্রাকটি রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের ক্যানালঘাটে যানজটে আটকা পড়ে। আড়াই ঘণ্টায় ধীরে ধীরে ট্রাকটি এক কিলোমিটার পথ এগোয়। এর মধ্যে মোটরসাইকেলে দুজন এসে ট্রাকের চালককে ইশারায় কী যেন বলে যান। জানতে চাইলে চালক বলেন, ‘ওরা দালাল। ঘাট ফাঁকা আছে দেখে ফোন দিলেই দ্রুত এগিয়ে যেতে বলল।’ চালক জানান, ফেরি পারাপারের টিকিট কাটতে ওদের কাছে ১ হাজার ৮০০ টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৬০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটে। বাকিটা দালালি হিসেবে ওরা রেখে দেয়। বহু বছর ধরে এমনটাই চলে আসছে।

ঢাকার কারওয়ান বাজারে সেই পেঁপে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, কচুর লতি ৭০ থেকে ৮০, পটোল ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে খুচরায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া বাঁধাকপি প্রতিটি ৪০ থেকে ৫০ ও লাউ ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা যায়।

কিছুক্ষণ পরে ওই দালালদের একজন চালককে ইশারা দিয়ে ৭ নম্বর ফেরিঘাটে ট্রাক নিয়ে যান। অন্তত ৩০০টি যানবাহন অতিক্রম করে ট্রাকটি ফেরিতে ওঠে। না হলে হয়তো আরও আড়াই ঘণ্টা ঘাটে বসে থাকা লাগত।

লেজারের আলো ফেলে চাঁদাবাজি

রাত সাড়ে ১১টায় ট্রাক কারওয়ান বাজারের পেট্রোবাংলা ভবনের সামনে গিয়ে থামে। সেখানকার আড়তে প্রায় অর্ধেক সবজি নামানো হয়। কারওয়ান বাজার থেকে ট্রাকটি বের হওয়ার সময় এক যুবক চালকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চোখে লেজার লাইটের আলো ফেলেন এবং ১০০ টাকা চাঁদা নেন।

ট্রাক যাত্রাবাড়ীর দিকে রওনা হয়। গুলিস্তান মোড়ে সিটি করপোরেশনের ১০০ ঢাকা ও ঢাকা জেলা ট্রাক ট্যাংকলরি কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ৩০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়।

যাত্রাবাড়ী বাজারে ৩৫০ টাকা চাঁদা

১২টা ৪০ মিনিটে যাত্রাবাড়ী ট্রাক পৌঁছাল। একদিকে ট্রাক থেকে পণ্য নামানোর কাজ চলে। অন্যদিকে ঢাকার একটি সিটি করপোরেশনের কর্মী গিয়ে চালকের হাতে ২০০ টাকা চাঁদার রসিদ গুঁজে দেন। রসিদে লেখা, ‘যাত্রাবাড়ী আড়ত এলাকা। কুলি–মজুরি আদায়। ইজারাদার প্রতিষ্ঠান: ৭–ইলেভেন ঢাকা।’ সিটি করপোরেশনের চাঁদা দেওয়ার পরপরই আরও একজন চালকের কাছ থেকে ১৫০ টাকা চাঁদা নেন। যাত্রাবাড়ী বাজারে সড়কের ওপরে সার বেঁধে ট্রাক রেখে পণ্য নামানোর জন্য এ চাঁদা নেওয়া হয়।

সবজির দামে ফারাক

গত রোববার যশোরের বারীনগর পাইকারি সবজির মোকামে কৃষক এক কেজি পেঁপের দাম পান ১৮ টাকা। কচুর লতি প্রতি কেজি ৪৫, পটোল ৩৬, প্রতিটি বাঁধাকপি ২০ ও লাউ ২৪ টাকা দরে পাইকারিতে কেনাবেচা হয়। পরদিন সোমবার ঢাকার কারওয়ান বাজারে সেই পেঁপে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, কচুর লতি ৭০ থেকে ৮০, পটোল ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে খুচরায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া বাঁধাকপি প্রতিটি ৪০ থেকে ৫০ ও লাউ ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা যায়।

যশোরের বারীনগর বাজারের সবজি ব্যাপারী আতিয়ার রহমান বলেন, যশোর থেকে ১১ টন সবজি ঢাকায় পাঠাতে ১৯ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া গুনতে হয়। এ ছাড়া ফেরি পারাপারা ভাড়া, সেতু ও ফ্লাইওভারের টোল, পথে সিটি করপোরেশন, শ্রমিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাঁদাবাজি তো আছেই। সব মিলিয়ে পাইকারি দামের তুলনায় খুচরা দামের পার্থক্য বেড়ে যায়।