কৃষি
সবজি চাষে ‘পলি হাউস’
হাসান যে পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করছেন, সেটি এই এলাকায় একেবারেই নতুন। আধুনিক পলি হাউসের মধ্যে তাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উৎপাদিত এ চারাগুলোর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি হয়ে থাকে। ফার্মে এখন বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ চারা উৎপাদন সম্ভব।
হাওর-অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জ। এখানে বৃষ্টি হয় প্রচুর। ফলে আগাম সবজি আবাদে চারাসংকটে পড়তে হয় চাষিদের। এই সংকট মেটাতে পুরো বছর বাণিজ্যিকভাবে চারা উত্পাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন এক তরুণ। ‘পলি হাউস’ পদ্ধতিতে উচ্চফলনশীল চারা উৎপাদন করছেন তিনি। মানসম্মত চারা পাওয়ায় এলাকায় সবজি চাষে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের। করোনাকালে নানা সীমাবদ্ধতা থাকার পরও এক মৌসুমেই নার্সারি থেকে বিক্রি হয়েছে বিভিন্ন জাতের আড়াই লাখ চারা।
‘গ্রিন হিল সিডলিং ফার্ম’ নামের এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা হাসান আহমদ (৩৫)। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের আমপাড়া এলাকায় গত বছর তিনি এই নার্সারির কার্যক্রম শুরু করেন। এখন জেলার বাইরে থেকেও চাষিরা এসে তাঁর নার্সারির উৎপাদিত চারা নিয়ে যাচ্ছেন। হাসান আহমদ বলেন, তিনি যে পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করছেন, সেটি এই এলাকায় একেবারেই নতুন। আধুনিক পলি হাউসের মধ্যে তাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উৎপাদিত এ চারাগুলোর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি হয়ে থাকে।
শুরুর কথা
হাসান সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর এলাকার বাসিন্দা। ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এরপর চাকরি করেছেন বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তবে তাঁর মনে সব সময়ই নিজে থেকে একটা কিছু করার পরিকল্পনা ছিল।
হাসান সর্বশেষ যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, সেখানে সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনার প্রকোপ শুরুর পর সেখানে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়। তিনি ভাবেন, এখনই সময় নিজের কিছু একটা করার। তাই চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। এরপর আধুনিক পদ্ধতিতে সবজির চারা উত্পাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে পড়াশোনা করেন প্রচুর। ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে নেন প্রশিক্ষণ। এরপর যা সঞ্চয় ছিল, তা নিয়ে নামেন মাঠে।
সদর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় তাঁর যাতায়াত ছিল আগেই। ওই এলাকার জমি তুলনামূলক উঁচু, সবজির আবাদ হয় বেশি। তাই সেখানেই তাঁর নার্সারি গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এলাকাটি গাছগাছালিতে ভরা। আবার উত্তরে তাকালেই মেঘালয় পাহাড়ের সবুজের হাতছানি। তাই প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন ‘গ্রিন হিল সিডলিং ফার্ম’। গত বছরের জুলাই মাসে এর উদ্বোধন করেন সুনামগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ। এই নার্সারি গড়তে তাঁর এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ টাকা। নার্সারিতে সার্বক্ষণিক কর্মী আছেন দুজন।
খামারে এক দুপুর
সুনামগঞ্জ শহরতলির সুরমা নদীর উত্তরপাড়ের আনন্দবাজার থেকে যে সড়কটি সীমান্তবর্তী ডলুরায় গেছে, তার মাঝামাঝি স্থানে আমপাড়া গ্রামে খামারটির অবস্থান। এখানে দুই বিঘা জমি ১০ বছরের চুক্তিতে ভাড়া নিয়েছেন হাসান। ১০ শতক জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে পলি হাউস। বিদেশ থেকে আনা ২০০ মাইক্রন পুরুত্বের পলির ছাউনি দেওয়া হয়েছে তাতে, যা অতিবেগুনি রশ্মি কমাতে সাহায্য করে। আবার অতিবৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টিতে চারার কোনো ক্ষতি হয় না। ছাউনির নিচে দেওয়া হয়েছে আমদানি করা বিশেষ একধরনের শেড নেট, যা সূর্যের ৫০ ভাগ তাপ কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া তিন ফুট পাকা দেয়ালের ওপর চারদিকে আরেক ধরনের জাল ব্যবহার করা হয়েছে, যা পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে চারাকে রক্ষা করে।
হাসান বলেন, পলি হাউসের ভেতরে মাচার ওপর প্লাস্টিক ট্রে এবং কাপে রাখা হয় চারা। নারকেলের ছোবড়ার গুঁড়া প্রক্রিয়াজাত করে জৈব সার বা কেঁচো সার মিশিয়ে দিয়ে তাতে বীজ বপন করা হয়। এতে কোনো মাটি ব্যবহার করা হয় না। বীজ বপন থেকে চারা রোপণ পর্যন্ত সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ দিন। এই চারা আবার এক সপ্তাহ রাখা হয় হিলিং চেম্বারে। পরে আনা হয় পলি হাউসে। বর্তমানে খামারে টমেটো, বেগুন, মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি, শসা, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরি, পেঁপে, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, জালি কুমড়া, চিচিঙ্গা, করলা, ঝিঙে, তরমুজের চারা উৎপাদিত হয়।
নার্সারিতে পেঁপে ছাড়া অন্য জাতের প্রতিটি চারা দেড় টাকা থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়। পেঁপের চারার দাম একটু বেশি। ১৫ থেকে ৩০ টাকা। এখানে উত্পাদিত চারা থেকে একেকটি পেঁপেগাছে ৫০ থেকে ৬০ কেজি পেঁপে পাওয়া যায়।
সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের ফেনিবিল গ্রামের বাসিন্দা মহিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা সবজির চারা আনি বিভিন্ন জায়গা থেকে, আবার নিজেরাও কিছু করি। নিজেদের বীজতলা অনেক সময় রোদ-বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ফার্ম হওয়ায় গত বছর সব চারা সেখান থেকে নিয়েছি।’
জগন্নাথপুর উপজেলা লহরি গ্রামের সবজিচাষি আল আমিন জানান, তিনি গত পাঁচ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে সবজির আবাদ করছেন। অন্য জায়গা থেকে চারা এনে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। চেয়েছেন এক জাত, চারা রোপণের পর জানতে পেরেছেন চারা আরেক জাতের। কিন্তু এ নার্সারিতে যেটা চেয়েছেন, সেটাই পেয়েছেন।
প্রতিষ্ঠান নিয়ে বড় স্বপ্ন
গ্রিন হিল সিডলিং ফার্মে এখন যে অবকাঠামো আছে, সেটিতে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ চারা উৎপাদন সম্ভব। তবে নার্সারিটিকে আরও বড় করার চিন্তা আছে হাসানের। তাঁর ইচ্ছা, এখানেই আরেকটি পলি হাউস করবেন। পাশে করা হবে বিভিন্ন জাতের সবজির প্রদর্শনী আবাদ। এ বছর বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বাঘবেড় এলাকায় খামারে আরেকটি শাখা চালু করা হবে। হাসান বলেন, এটা আসলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। শুধু সিলেট বিভাগ নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর ফার্ম থেকে চারা যাবে, সে রকম চিন্তা করে এগোচ্ছেন।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, নার্সারিটি একটি চমত্কার উদ্যোগ। বাড়ির কাছে সহজে উচ্চফলনশীল ও মানসম্মত চারা পেয়ে সবজিচাষিরা উপকৃত হচ্ছেন।