সবুজ নেই জাপান গার্ডেন সিটিতে

ছুটির দিনে শিশুরা মেতে উঠে নানা খেলায়। কিন্তু সিটির ভেতর হুটহাট চলাচলকারী গাড়ি ও অন্য যানবাহন তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি l প্রথম আলো
ছুটির দিনে শিশুরা মেতে উঠে নানা খেলায়। কিন্তু সিটির ভেতর হুটহাট চলাচলকারী গাড়ি ও অন্য যানবাহন তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি l প্রথম আলো

নাম ‘জাপান গার্ডেন সিটি’। তবে এখানে জাপানের নাগরিক নয়, থাকেন বাংলাদেশিরা। আবাসিক এলাকাটির নামের সঙ্গে ‘গার্ডেন’ থাকলেও ভেতরে কোনো বাগান নেই। বেশ বড় একটি সুইমিং পুল আছে, কিন্তু তাতে পানি নেই। তবে এ সিটির বাসিন্দাদের রাজধানীর অন্যান্য এলাকার বাসিন্দাদের মতো পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ নিয়ে দুর্ভোগে পড়তে হয় না। নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত নন তাঁরা।
গতকাল শনিবার দুপুরে মোহাম্মদপুরের রিং রোডে অবস্থিত এই আবাসিক এলাকায় গিয়ে বাসিন্দারা কেমন আছেন জানতে চাইলে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের নানান সুখ-দুঃখের কথা জানালেন। এখানে ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের মধ্যে একধরনের বন্ধুত্বও তৈরি হয়েছে, যা অন্যান্য এলাকায় তেমন একটা দেখা যায় না।
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জাপান গার্ডেন সিটি লিমিটেডের একটি প্রকল্পের আওতায় এ সিটি গড়ে উঠেছে ১০ একর জায়গায়। ভেতরে বর্তমানে ২০টি ভবনে ১ হাজার ৪৪৩টি পরিবারের বাস। আরও ছয়টি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে মোট ২৬টি ভবনে ১ হাজার ৬২৩টি পরিবার বসবাস করবে। দুটি ভবন ১৬ তলা, অন্যগুলো ১৫ তলা। ‘আকিহাবারা’, ‘সাকুরা’সহ জাপানি শব্দে ভবনগুলোর নামকরণ করা।
শনিবার সরকারি ছুটি থাকায় দুপুরের দিকে বিভিন্ন ভবনের নিচের ফাঁকা জায়গায় ছেলেমেয়েদের সাইকেল চালানোসহ বিভিন্ন খেলায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। তবে সিটির ভেতরে হুটহাট চলাচলকারী ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল ও রিকশাকে ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে মনে করছেন বাসিন্দারা।
প্রতিটি ভবনে নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্ল্যাটের মালিকদের মধ্যে কমিটি গঠন করা হয়। আবার এসব কমিটির সদস্যদের নিয়ে ৪৩ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। এ কমিটিই সিটির বাসিন্দাদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলোর তদারক করে। সিটির ভেতরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি না হওয়া, বাগান না থাকা বা সুইমিং পুলে পানি না থাকার বিষয়ে কমিটির সদস্যরা দোষ দিচ্ছেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে। বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, কমিটিতে পদ পাওয়া নিয়ে সবার মধ্যে তোড়জোড় থাকলেও বাসিন্দাদের সুবিধা দেখার দিকে তাঁদের মনোযোগ ততটা থাকে না। কমিটির সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্বও লেগে থাকে সারাক্ষণ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভাড়াটে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাব বলে এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম, তার বেশির ভাগই পাচ্ছি না। গত ছয় বছরে জাপান গার্ডেন সিটির ভেতরে কোনো গার্ডেনেরই দেখা পেলাম না। সুইমিং পুলেও পানি নেই। কংক্রিটের এই আবাসনের চারপাশে কোনো প্রাণের ছোঁয়া নেই।’
নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সিটির দেখভালকারীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তৌহিদুজ্জামান বলেন, ‘প্রকল্পে নিয়মের বাইরে কিছুই করা হয়নি। সুইমিং পুল হয়েছে তিন বছর আগে। ঝরনা তৈরি আছে। তবে কমিটির সদস্যরা একমত হতে পারছেন না—এটা সুইমিং পুল হবে, নাকি লেক হবে। স্কুল ও কলেজ তৈরির বিষয়টি পরিকল্পনায় আছে। সিটির ভেতরে ৫৭ শতাংশ খোলা জায়গা রাখা হয়েছে।’
ব্যতিক্রম চিত্রও আছে। শহরের অন্য এলাকায় নিজের বাড়ি থাকার পরও অনেকে সেই বাড়ি ভাড়া দিয়ে এখানে ভাড়াটে হিসেবে থাকছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ এবং নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। সিটির ভেতরেই নিজস্ব জেনারেটর, পানির পাম্প, আনসার ক্যাম্প আছে। একজন বাসিন্দা জানালেন, বাইপাস সার্জারির পর চিকিৎসক হাঁটতে বলেছেন। এখানে হাঁটাচলার প্রচুর জায়গা রয়েছে। তাই শান্তিনগরে নিজের বাড়ি রেখে এখানে থাকছেন সকাল-বিকেল হাঁটার জন্য। প্রকল্পের আওতায় তৈরি হয়েছে টোকিও স্কয়ার নামের একটি শপিং মল। ফলে সিটির বাসিন্দাদের যানজট ঠেলে অন্য জায়গায় কেনাকাটার জন্য যেতে হচ্ছে না। এটাই বা কম কিসে? নিরাপত্তাকর্মীর কাছে পর্যাপ্ত তথ্য না দিয়ে বাইরের কেউ কোনো ভবনে ঢুকতে পারে না। প্রতিটি ভবনেই আছে সিসিটিভি। জরুরি অবতরণ সিঁড়ি আছে। ভেতরেই আছে চারতলা মসজিদ।
ফ্ল্যাটের মালিক শাহীদুল ইসলাম, মোশাররফ হোসেন, গোলাম ফারুকসহ কয়েকজন সিটির নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বলেন, অনেকে এখানে পরিবার রেখে দেশের বাইরে চাকরি করছেন দিনের পর দিন। ফ্ল্যাট তালা দিয়েও অনেকে নিশ্চিন্ত মনে যে যাঁর কাজে যেতে পারছেন। নারীরা রাতের বেলায় ভেতরে হাঁটছেন নিশ্চিন্ত মনে।
বিশেষ দিবস, ঈদ, পূজা-পার্বণে সিটির ভেতরে চলে নানান আয়োজন। গতকাল হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা সিটির ভেতরেই মণ্ডপ সাজিয়ে সরস্বতী পূজার আয়োজন করেন। এখানে কথা হয় ফ্ল্যাটের মালিক কে বি মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি সিটির ভেতরে বিভিন্ন সুবিধার কথা বলার পাশাপাশি খানিকটা আক্ষেপ নিয়েই বললেন, সিটির ভেতরে একেকটি ভবন একেকটির গায়ে লেগে রয়েছে। মনে হবে ভবনের স্তূপ। আর সিটির ভেতরে মাটি নেই বললেই চলে।
সিটির ভেতরে বিভিন্ন ভবন এখনো তৈরি হচ্ছে। ইট-সিমেন্টের স্তূপ পড়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়। ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ল কয়েক জায়গায়। সিটির ২১ নম্বর ভবনের বাসিন্দাদের অনেকেই ক্ষোভ জানালেন তাঁদের ভবনের কমিটি নিয়ে। তাঁদের অভিযোগ, নিয়মমাফিক নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি হয়নি। এ ভবনের ভাড়াটে কামরুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটির গুটি কয়েক সদস্যের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ। অন্য ভবনে এমন সমস্যা নেই। কেন্দ্রীয় কমিটির কাছেও এ নিয়ে অভিযোগ করেছি। অনেকে থানায় অভিযোগ করেছেন। অনেকে বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন দুর্ব্যবহারের কারণে।’
কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাগজে-কলমে অনেক কিছু আছে। সব বাস্তবায়িত হয়নি। কিছু ভবনে কমিটি গঠন নিয়ে সমস্যাও আছে।’