সব উদ্যোগই আটকে আছে

সাড়ে তিন বছরেও সড়ক আইন কার্যকর করা যায়নি। পরিবহনমালিক শ্রমিকদের চাপে সরকারি সিদ্ধান্ত তাঁদের পক্ষেই যায়।

আইনের সংশোধনের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইউসুফ আলী মোল্লা। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশ এবং বাস্তবতার নিরিখে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো পক্ষের চাপের বিষয় নেই।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন

নিরাপদ সড়কের সব উদ্যোগ আটকে যাচ্ছে পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের চাপে। সাড়ে তিন বছর আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, জানিয়েছিল কিছু উদ্যোগের কথাও। কিন্তু শিক্ষার্থীরা আন্দোলন ছেড়ে শ্রেণিকক্ষে ফেরার পর বিভিন্ন দাবিতে পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা রাস্তায় নামেন। এরপর সরকারের প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগও সব আটকে যায়। ফলে ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা গিয়েছিল, চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই তা ছাড়িয়ে গেছে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন যে পক্ষ শক্তি দেখাতে পারে, সে পক্ষকে খুশি করার চেষ্টা করে সরকার। তবে পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা যেহেতু সংগঠিত এবং প্রভাবশালী, দিন শেষে সরকারি সিদ্ধান্ত তাঁদের পক্ষেই যায়।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মূল দাবি ছিল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির কারণে চালকের মৃত্যুদণ্ডের আইন প্রণয়ন করা। সরকার শিক্ষার্থীদের খুশি করতে তড়িঘড়ি করে ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস করে। এতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান না রাখলেও সাজার পরিমাণ তিন বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়। জরিমানার পরিমাণও বৃদ্ধি করা হয়।

আইনটি পাসের প্রায় এক বছর দুই মাস পর তা কার্যকরের ঘোষণা আসে। তখন আইনটি সংশোধনের দাবিতে পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে সারা দেশ কার্যত অচল করে দেন। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিবহনমালিক-শ্রমিকনেতাদের নিয়ে দুই দফা বৈঠক করে আইনটি সংশোধনের আশ্বাস দেন।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
প্রথম আলো ফাইল ছবি

গত বছরের শেষের দিকে আইনটি সংশোধন করে প্রায় প্রতিটি ধারা শিথিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমান সড়ক আইনে ৪২টি ধারায় অপরাধ এবং কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে আইন কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়ার পর পরিবহনমালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ৩৪টি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব আসে। এর মধ্যে ২৯টি ধারা আমলে নিয়ে সংশোধনের সুপারিশ করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। আইন নিয়ে পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের এই দর-কষাকষির ফলে এ-সংক্রান্ত বিধিমালাও তিন বছরে প্রণয়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।

সংশোধনের প্রস্তাবটি এখন মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। সেখানে অনুমোদন পেলে তা জাতীয় সংসদে পাসের জন্য তোলা হবে।

আইনের সংশোধনের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইউসুফ আলী মোল্লা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশ এবং বাস্তবতার নিরিখে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো পক্ষের চাপের বিষয় নেই।

শিক্ষার্থীদের আরেকটি বড় দাবি ছিল ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালক যেন যানবাহন চালাতে না পারেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর এটি আর বাস্তবায়ন করা যায়নি। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন জমা দেয় বিআরটিএ। এতে দেখা যায়, সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৪ লাখ ৭৯ হাজার। বিআরটিএ সূত্র বলছে, এরপর করোনা পরিস্থিতিতে ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করার বিষয়ে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। এ ছাড়া যানবাহনের চালকের সংখ্যাও বাড়েনি এ সময়।

মালিক-শ্রমিকেরা বাধা দেয় ঠিক আছে। তবে সব বাধা অযৌক্তিক নয়, বরং সরকারেরও সক্ষমতার ঘাটতি আছে। পথচারীরা আইন মানে না। সবারই দোষ আছে
শাজাহান খান

এর বাইরে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার বিষয়েও কিছু হয়নি। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৩০ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোরও বেশির ভাগ বাস্তবায়িত হয়নি।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে সরকার বিব্রত হয়। কিন্তু পরিবহনমালিক-শ্রমিকনেতারাও সরকারের ভেতর প্রভাবশালী। তাঁদেরও অখুশি করতে চায় না সরকার। এ জন্য যখন যে ইস্যু সামনে আসে, সেটা সামাল দেওয়া হয়।

দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান। পরিবহনমালিকদের সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতা জাতীয় পার্টির মসিউর রহমান এবং আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সহসভাপতি খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তাঁরা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএর সড়ক নিরাপত্তাসংক্রান্ত প্রায় সব কমিটির সদস্য।

জানতে চাইলে শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, মালিক-শ্রমিকেরা বাধা দেয় ঠিক আছে। তবে সব বাধা অযৌক্তিক নয়, বরং সরকারেরও সক্ষমতার ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মহাসড়কের পাশে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিন বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। পথচারীরা আইন মানে না। সবারই দোষ আছে।

সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে

সড়ক দুর্ঘটনার সরকারি হিসাব সংরক্ষণ করে পুলিশ। সংস্থাটির হিসাবে, ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৬২৯টি। এতে মারা গেছেন ২ হাজার ৬৩৫ জন। ২০১৯ সালে দুর্ঘটনা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ১৪৭টি। মৃত্যু বেড়ে হয় ৪ হাজার ১৩৮ জন। গত বছরের বড় একটা সময়জুড়ে দেশে করোনা বিধিনিষেধ ছিল। যানবাহন চলাচল কমেছে। কিন্তু সড়কে প্রাণহানি কমেনি। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৪ হাজার ১৯৮টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় ৩ হাজার ৯১৮ জনের। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রথম আট মাসে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩ হাজার ৭০১টি। প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৫০২ জন।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনা কিংবা প্রাণহানি কমে যাওয়ার মতো কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা হয়নি। সরকারের কথায় দুর্ঘটনা কমার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, যানবাহনমালিক, শ্রমিক ও পথচারীদের আইন মেনে চলার মতো কোনো ব্যবস্থা সরকার করতে পারেনি। অর্থাৎ মানুষ মরার সব ধরনের আয়োজন সড়কে করে রাখা হয়েছে। এটা শুধু কথা দিয়ে হবে না। বলিষ্ঠ পদক্ষেপ লাগবে। সেটা সরকারই করতে পারে। এটা যে সরকার পারছে না, তা পরিষ্কার। তা না হলে সিটি করপোরেশনের চালক গাড়িটি অন্যের হাতে তুলে দিতে পারত না। এমন ঘটনা সর্বত্রই ঘটছে।

পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের স্বার্থে সংশোধন

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আইনে যতগুলো ধারা সংশোধনের মাধ্যমে শিথিল করার সুপারিশ করা হয়েছে, একটি বাদে সব কটিই পরিবহনচালক, মালিক ও কর্তৃপক্ষের শাস্তিসংক্রান্ত। একটি ধারা শুধু জনগণ সম্পৃক্ত।

সড়ক আইনের সবচেয়ে কঠোর ধারা হচ্ছে ৮৪, ৯৮ ও ১০৫। এগুলো অজামিনযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এবার সংশোধনে ৮৪ ও ৯৮ ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য করার সুপারিশ এসেছে। এমনকি ৯৮ ধারার অপরাধকে আপসযোগ্য করার কথা বলা হয়েছে।

১০৫ ধারায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু সংশোধনের সুপারিশে কারাদণ্ড পাঁচ বছর রেখে জরিমানা কমিয়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

৯৮ ধারাটিও সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত। এই ধারায় নির্ধারিত গতির অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চালালে, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং, ওভারলোডিংয়ের কারণে দুর্ঘটনা হলে এর জন্য চালক, কন্ডাক্টর বা সহায়তাকারীর তিন বছরের কারাদণ্ড কিংবা তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের দাবি মেনে আইনটি সংশোধন হলে সব ধরনের অপরাধের জরিমানা কমবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

চাপ এলে সরকার নড়েচড়ে

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নতুন আইন প্রণয়নে কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১১ সালে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষ মাঠে নামেন। এতে আইন প্রণয়নের দাবি জোরালো হয়। কিন্তু এই আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর মালিক-শ্রমিকেরা ধর্মঘটে নামেন। তখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার ইলিয়াস কাঞ্চনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ছবি অবমাননা করা হয়।

২০১২, ২০১৩, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সড়ক আইনের চার দফা খসড়া প্রণয়ন করা হয়। শুরুতে সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যক্তির মৃত্যুর দায়ে সাত বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত শাস্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রতিটি খসড়ার সময়ই পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে শাস্তি কমানোর দাবি এসেছে। আইনের খসড়া শিথিল হয়েছে। এই ধারা এখনো চলছে।

নিরাপদ সড়ক চাই–এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহনমালিক–শ্রমিকেরা সরকারের ভেতরই আছে। ফলে সরকার তাদের স্বার্থই দেখে। শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ মাঠে নামলে সরকার নড়েচড়ে। কিন্তু মালিক-শ্রমিকদের চাপে আবার থেমে যায়। মালিক-শ্রমিকদের চেয়ে শক্তিশালী চাপ প্রয়োগ না করতে পারলে সরকারের হুঁশ ফিরবে না।