সব নির্যাতন ছাড়িয়ে ধর্ষণই বেশি

নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোর মধ্যে এক–তৃতীয়াংশই ধর্ষণের ঘটনা। সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করার পরও এই অপরাধের লাগাম টানা যাচ্ছে না।

নারীর প্রতি সহিংসতার যতগুলো ধরন আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ধর্ষণ। দেশে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে এই ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার মতো অপরাধ অন্য অপরাধগুলোকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পৃথক দুটি বেসরকারি সংস্থার গত দুই মাসের হিসাব এমন চিত্রই তুলে ধরছে।

দেশে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৬৭ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২২৯ জন। এটা মোট নির্যাতনের ঘটনার ৪০ শতাংশ। ১৩টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এ–সংক্রান্ত খবর পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এই তথ্য দিয়েছে। ধর্ষণের পরেই রয়েছে রহস্যজনক মৃত্যু, শারীরিক নির্যাতন, অপহরণ, যৌতুকের কারণে হত্যা ও নির্যাতন, আত্মহত্যা, বাল্যবিবাহ এবং অ্যাসিড সহিংসতার মতো ঘটনাগুলো।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, শুধু গত জানুয়ারি মাসে ১৩০টি নারী নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাই ছিল ৮৪টি। ৯টি জাতীয় দৈনিক ও কয়েকটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত খবর এবং নিজেদের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এমনটি বলছে তারা। তাদের হিসাবে জানুয়ারি মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের মোট ঘটনার ৬৪ শতাংশই ছিল ধর্ষণ। এই এক মাসে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে (আহত ও নিহত) ২০ দশমিক ৭ শতাংশ, যৌন হয়রানি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, অ্যাসিড সহিংসতা ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। বাকি অন্যান্য।

সামাজিক কাঠোমোর মধ্যে যেসব পরিবর্তন এলে ধর্ষণ কমত, সে পরিবর্তন আনা হয়নি বলেই ধর্ষণ বেড়ে চলছে।
খন্দকার ফারজানা রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ধর্ষণের ঘটনা রোধ করা তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। গত বছরের অক্টোবরে সরকার ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবন থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করেছে। কিন্তু অপরাধ কমার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। তদন্তে পুলিশের গাফিলতি, মামলায় বেশিসংখ্যক সাক্ষী রাখা, ডিএনএ পরীক্ষা, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, ভুক্তভোগীর মামলা চালিয়ে নেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য না থাকা—সর্বোপরি বিচার বিলম্বিত হওয়াই সমাজে এই অপরাধটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক কাঠোমোর মধ্যে যেসব পরিবর্তন এলে ধর্ষণ কমত, সে পরিবর্তন আনা হয়নি বলেই ধর্ষণ বেড়ে চলছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশের জন্য গঠনমূলক পাঠ্যক্রম, পরিবার, সমাজের জেন্ডার সংবেদনশীল ও মানবিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সাংস্কৃতিক ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডকে গুরুত্ব দেওয়া। এসব জায়গায় এখনো কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি আরও বলেন, অপরাধ সংঘটনের পরবর্তী অবস্থা নিয়ে কাজ করে আইন। তাই শুধু সাজা বাড়িয়ে অপরাধ কমানো যায় না।

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুসারে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছিল ২০ হাজার ৭১৩টি, যার ৩৩ শতাংশ ছিল ধর্ষণ। এর আগের বছর মোট নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলার প্রায় ৩১ শতাংশ ছিল ধর্ষণের।

ধর্ষণের ঘটনা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশনা বিভিন্ন পর্যায়ে দেওয়া আছে। পাশাপাশি সুষ্ঠু বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

গত বছরের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ, ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রবাসে নববিবাহিত এক তরুণীকে ছাত্রলীগের কর্মীদের দলবদ্ধ ধর্ষণ, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়া—এসব ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া, বিক্ষোভ হয়। এরপর ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ১৩ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে সরকার। সেই সঙ্গে ভুক্তভোগী ও আসামির ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়।

সাজা বাড়ানোর আগের এবং পরের মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে প্রথম আলো। এতে প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে প্রকাশ হওয়া ধর্ষণের ঘটনাগুলোই শুধু পর্যালোচনা করা হয়। দেখা যায়, সাজা বাড়ানোর আগের এক মাসে ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ১১৬ জন নারী–শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর সাজা বাড়ানোর পর ১৪ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত এক মাসে ১৮৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণের ঘটনা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশনা বিভিন্ন পর্যায়ে দেওয়া আছে। পাশাপাশি সুষ্ঠু বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

ধর্ষণের মামলার মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। পুলিশ, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা না গেলে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি হবে না।
মাকছুদা আখতার, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড ইউনিটের পরিচালক

কষ্টের জীবন বয়ে বেড়ানো

ধর্ষণের পরও জীবনের ঝুঁকিতে আছেন গাজীপুরের সেই পোশাককর্মী (২৫), যিনি কারখানায় কাজ শেষে বাজার সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণের পর দা দিয়ে তাঁর গলা কাটার চেষ্টার সময় অফিসফেরত দুজন সাইকেলযাত্রী দেখে ফেলায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যারাতে এ ঘটনা ঘটে। এখন প্রচণ্ড মানসিক–শারীরিক বিপর্যয় ও জীবননাশের হুমকির মধ্যে আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনজনের নামে কাশিমপুর থানায় মামলা করেছেন। এই আসামিদের বিরুদ্ধে আগেও ধর্ষণের অভিযোগ ছিল। তিন আসামিই এখন কারাগারে।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কার্যকরী সভাপতি কাজী রুহুল আমিন ওই পোশাককর্মীর খোঁজখবর রাখেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাঁদা তুলে বেশ কয়েক দফা চিকিৎসার পরও তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁর চাকরিটা যেন থাকে সেই অনুরোধ জানিয়েছি কারখানা কর্তৃপক্ষকে।’

নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় গত ৯ অক্টোবর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিশোরীকে বাড়িতে একা পেয়ে ধর্ষণ করেন আরেক গ্রামের এক যুবক। লোকজন ধাওয়া করে অভিযুক্তকে আটক করে পলাশ থানায় দেন। ২ ডিসেম্বর আসামি জামিনে মুক্তি পায়। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পলাশ থানার উপপরিদর্শক মো. সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আসামিকে জামিন দিয়েছেন আদালত। পুলিশের কিছু করণীয় নেই। সংশোধিত আইন অনুসারে ভুক্তভোগী ও আসামির ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসামি গ্রেপ্তার থাকায় ডিএনএ টেস্ট করার প্রয়োজন ছিল না।

এদিকে এই ঘটনায় এখন মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে আসামির পরিবার। ব্যাপারে ৭ ডিসেম্বর আবার থানায় জিডি করেন মেয়েটির মা। তীব্র অর্থসংকটে মামলার ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত এই মা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা পাই, তা দিয়ে সংসার চলে। মামলার জায়গায় জায়গায় টাকা লাগে, এত টাকা কোথায় পাব?’

দেশে গত বছরের শেষ দিকে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমানোর দাবি করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছিলেন, পার পাওয়ার সুযোগ থাকে বলেই নির্যাতনকারীরা আইনের তোয়াক্কা করে না। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড ইউনিটের পরিচালক মাকছুদা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণের মামলার মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। পুলিশ, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা না গেলে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি হবে না।