সরকারের টাকা মেরে খাচ্ছে মন্ত্রী-সাংসদদের ৯ প্রতিষ্ঠান

সরকারের টাকা মেরে খাচ্ছে মন্ত্রী-সাংসদদের ৯ প্রতিষ্ঠান
সরকারের টাকা মেরে খাচ্ছে মন্ত্রী-সাংসদদের ৯ প্রতিষ্ঠান

রাজনৈতিক আনুকূল্যে আইজিডব্লিউ (আন্তর্জাতিক গেটওয়ে) প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিয়ে এখন সরকারের টাকা মেরে খাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাত্র নয়টি প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) রাজস্ব ও নিবন্ধন নবায়ন বাবদ সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা পাওনা হয়েছে।
লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করলেও বিটিআরসিকে প্রাপ্য টাকা দিচ্ছে না সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, আওয়ামী লীগের আলোচিত নেতা শামীম ওসমান, বাহাউদ্দিন নাছিম, নসরুল হামিদ, জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন বাবলুর নিজের অথবা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নামে নেওয়া প্রতিষ্ঠান।
বিদেশ থেকে করা (আন্তর্জাতিক ইনকামিং) কলগুলো আইজিডব্লিউ অপারেটরের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করে এবং সংশ্লিষ্ট মোবাইল ও টেলিফোনের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো হয়। আইজিডব্লিউর নীতিমালা অনুসারে, প্রতি মিনিট আন্তর্জাতিক টেলিফোন কল দেশে আনার সঙ্গে তিন সেন্ট করে দেশে আসে। এই তিন সেন্টের ৫১ দশমিক ৭৫ শতাংশ রাজস্ব ভাগাভাগির চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে দিতে হয়। এ ছাড়া আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধন নবায়ন বাবদ প্রতিবছর সাড়ে সাত কোটি টাকা দিতে হয়।
বিটিআরসির সূত্র স্বীকার করেছে, বিপুল এই অর্থ আদায় নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ আবার অর্থ পরিশোধ না করে সরকারের বাকি সময় কাটিয়ে দিতে চাইছেন। তাঁদের মনোভাব হচ্ছে, এর জন্য লাইসেন্স বাতিল করলেও সমস্যা নেই। ব্যবসা থেকে যথেষ্ট কামাই তাঁদের হয়ে গেছে। ফলে দুই বছর ধরে বারবার নোটিশ দেওয়া হলেও বেশির ভাগ ব্যক্তিই বিটিআরসির পাওনা দিচ্ছেন না।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের বকেয়া আছে, তাঁদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সময় অনুসারে তাঁদের কাছে সঠিক উত্তর না পেলে লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এ ছাড়া অর্থ আদায়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথাও ভাবছে বিটিআরসি।
আইন সংশোধন করে লাইসেন্স: ২০০৮ সাল পর্যন্ত কেবল সরকারি রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিফোন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) আইজিডব্লিউর লাইসেন্স ছিল। ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নিলামে এই লাইসেন্স দেওয়া হয়। লাইসেন্স পেয়েছিল নভোটেল, বাংলা ট্র্যাক ও মীর টেলিকম। এই সময়ে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা ছিল কেবল বিটিআরসির। ২০১২ সালে আইন সংশোধন করে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা নিজেই নিয়ে নেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। ২০১২ সালে আরও আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বিটিআরসি চারটি লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করে। কিন্তু মন্ত্রণালয় ২৫টি লাইসেন্স দেয়। এ সময়ই লাইসেন্স পান মন্ত্রী, সাংসদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়ের নথিতেও মালিকদের পরিচয় রয়েছে।
রাজনৈতিক প্রভাবে টেলিযোগাযোগ খাতে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা শামীম ওসমান। তাঁর কে টেলিকমের কাছে বিটিআরসির রাজস্ব বাবদ ৮৫ কোটি ৭৮ লাখ এবং নিবন্ধন নবায়ন বাবদ আরও সাড়ে সাত কোটিসহ মোট ৯৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক হিসেবে নাম রয়েছে তাঁর স্ত্রী সেলিমা ওসমান এবং ছেলে ইমতিয়ান ওসমান, শ্যালক তানভির আহমেদ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিথ কনসার্নের মালিক জয়নাল আবেদীন মোল্লার। নেপথ্যে থেকে মূলত শামীম ওসমান এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। প্রথম আলোর প্রতিনিধির কাছে পাঠানো এক খুদে বার্তায়ও (এসএমএস) শামীম ওসমান নিজেকে কে টেলিকমের প্রধান উপদেষ্টা ও পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেন। নথি অনুযায়ী তাঁর নিজের নামে শেয়ার নেই। তবে বিটিআরসি কার্যালয়ে কে টেলিকমের পক্ষে তদবির করতে তিনি নিজেই আসেন।
একইভাবে রাতুল টেলিকমের মালিক সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের পরিবার। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে আছেন স্ত্রী সৈয়দা আঞ্জুমান বানু এবং অংশীদার হিসেবে আছেন তাঁর মেয়ে সৈয়দা আমরিন। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে বিটিআরসির রাজস্ব বাবদ ৮৯ কোটি ২৯ লাখ, নিবন্ধন নবায়ন বাবদ সাড়ে সাত কোটি টাকাসহ ৯৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর কবির নানকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে গতকাল রাত সোয়া নয়টার দিকে তিনি বলেন, তিনি একটি অনুষ্ঠানে ব্যস্ত আছেন। পরে যোগাযোগ করার কথা বলে তিনি মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক নিয়েছিলেন মস-৫ টেল নামের একটি আইজিডব্লিউর লাইসেন্স। তাঁর ছেলে জিয়াউল হক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক। সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রী ইলা হকও প্রতিষ্ঠানের অংশীদার। নিবন্ধন নবায়ন ও রাজস্ব বাবদ এই প্রতিষ্ঠানের বকেয়া রয়েছে ৩৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা। যোগাযোগ করা হলে রুহুল হকের ছেলে জিয়াউল হক তাঁদের মালিকানাধীন আইজিডব্লিউর বকেয়া থাকার বিষয় স্বীকার করে বলেন, যথাসময়ে বকেয়া পরিশোধ করা হবে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বর্তমান উপদেষ্টা জিয়াউদ্দিন বাবলু ফার্স্ট কমিউনিকেশন্স নামের প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে বিটিআরসির পাওনা রয়েছে ২৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
ভিশন টেলের মালিকানার পেছনে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। তাঁর বড় ছেলে এস এম সামস এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির পর তিনি এই প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর অংশীদার প্রত্যাহার করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে রাজস্ব ও নিবন্ধন নবায়ন বাবদ বিটিআরসির পাওনা ১৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, এস এম সামস এই আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের হয়ে তদবির করতে বিটিআরসিতে আসেন। ৫ ডিসেম্বরও এই প্রতিবেদক তাঁকে বিটিআরসির কার্যালয়ে যেতে দেখেছেন।
সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের লাইসেন্স নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি ইতিমধ্যে মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে রাজস্ব ও নিবন্ধন নবায়ন বকেয়া বাবদ ১৬ কোটি আট লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। জানতে চাইলে বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিগমা গ্রুপ আমার নয়, তবে এটি আমার আত্মীয় সৈয়দ আসেদ রেজার।’
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আবদুস সোবাহান মিয়া তাঁর স্ত্রী গুলশান আরা মিয়ার নামে রুটস কমিউনিকেশন্স আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেন। এই প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নবায়ন ও রাজস্ব বাবদ ১০ কোটি দুই লাখ টাকা বকেয়া রেখেছে।
আওয়ামী লীগের ঢাকা-৩ (কেরানীগঞ্জ) আসনের সাংসদ নসরুল হামিদ বিপু হামিদ সোর্সিং আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স পেয়েছিলেন। তাঁর ভাই এনতেখাবুল হামিদও প্রতিষ্ঠানটির অংশীদার। বর্তমানে হামিদ সোর্সিংয়ের কাছে নিবন্ধন নবায়ন ও রাজস্ব বাবদ ছয় কোটি ১৫ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।
বাংলা টেল প্রভাবশালী আলোচিত ব্যবসায়ী ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর আলীর নিয়ন্ত্রণে। তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বোরাক রিয়েল এস্টেট এর মালিকানায় রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে রাজস্ব ও নিবন্ধন নবায়ন বাবদ বকেয়া রয়েছে ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। যদিও তিনি যথেষ্ট সম্পদশালী।
আরও বকেয়া: বিটিআরসির সূত্র জানায়, সবচেয়ে বেশি বকেয়া রেখেছে সরকারি টেলিফোন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। প্রতিষ্ঠানটি গত দুই বছরে কোনো রাজস্ব পরিশোধ করেনি। এতে বিটিসিএলের বকেয়া হয়েছে ৩৯৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এ ছাড়া বেস্টটেক টেলিকম, টেলেক্স, অ্যাপল নেটওয়ার্কস, ডিজিকন, এসএম কমিউনিকেশন, গ্লোবাল ভয়েস, এইচআরসি টেকনোলজি, ইউনিক ইনফোওয়ে, ডিবিএল টেলিকম, সেল টেলিকম, র্যাংকসটেল, প্লাটিনাম কমিউনিকেশন্স, ভেনাস টেলিকম, বিজি টেল, বিআইজিএল এবং ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্সের কাছে রাজস্ব ও লাইসেন্স নবায়ন বাবদ ৪৬২ কোটি ৪১ লাখ টাকা পাওনা। বিটিসিএলসহ কোম্পানিগুলোর কাছে মোট বকেয়া ৮৫৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেনামে আওয়ামী লীগের আরও নেতারা রয়েছেন বলে বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে।
তবে সর্বশেষ খবর হচ্ছে, বাংলা ট্র্যাক, মিরটেল, নভোটেল ও বিজি টেল রাজস্ব বাবদ অর্থ পরিশোধ করেছে। আর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে বিটিআরসি।