সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগ

>
.
.
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, প্রথম আলো ও এইচএসবিসি বাংলাদেশের আয়োজনে ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো এই ক্রোড়পত্রে।

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম: আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগ’। এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আমরা আলোচনা করব। নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষা চালু হয়েছে, উচ্চ আদালতে এখনো হয়নি। এটা নিয়ে অনেকের মধ্যে মতভেদ আছে যে উচ্চ আদালতে দরকার আছে কি না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, অন্তত একটা কমিটি থাকা উচিত। যে কমিটি বছরে এক বা দুবার আলোচনা করে ঠিক করে নেবে, কোন কোন বিদেশি শব্দ আমরা বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারি। আমেরিকায় এ রকম কমিটি আছে। চীনে আমি দেখেছি, সেখানকার সাইনবোর্ডগুলো সব চীনা ভাষায় লেখা হলেও নম্বরগুলো ইংরেজিতে। আমরা এখন বলি যে সাইনবোর্ড সব বদলাও। সব বাংলায় করো। এটার সঙ্গে আমরা দ্বিমত করি না। কিন্তু নম্বর আমি ইংরেজিতে দিলে একজন বিদেশি এলে চট করে বুঝতে পারবেন।

সাজ্জাদ শরিফ: আমাদের সংবিধানের প্রথম ভাগের ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ এর মানে সংবিধান যেদিন প্রণীত হলো, সেদিন থেকেই এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আমরা দেখছি, প্রশাসনে বাংলার ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু এর উল্টো দিকে অন্ধকারও আছে। ১৯৮৭ সালে দেশে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন হয়েছে। আইন করার পরে যে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হয়েছে, সেটা আমরা বলতে পারি না। উচ্চ আদালতে বাংলা চালু হয়নি। সেখানে আইনি পরিভাষার দোহাই দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েকজন সম্মানীয় বিচারপতি বাংলা ভাষায় রায় দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে বাংলা ভাষায় রায় দেওয়া যায়। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও জটিলতা থেকে গেছে। যেখানে আমরা বাংলার প্রচলন করতে পারিনি। রাষ্ট্রের একটা ভাষানীতি এবং ভাষা–পরিকল্পনা থাকা দরকার। আর তা দরকার একটা ভবিষ্যৎ-মুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আমাদের এসব হয়নি। হ্যাঁ, অন্য ভাষা শিখতে হবে। কিন্তু সেটা আমাদের বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে তো নয়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, আমরা যদি এই প্রশ্নগুলো তুলতে পারি, সেসব সমস্যা মেটাতে আমরা কীভাবে এগোতে পারি—এই আলোচনাটা আজ করতে পারলে ভালো হয়।

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম

রফিকুল ইসলাম: ভাষা সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতার বিষয়টা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই। আজকাল আমাদের দেশে যত অনুষ্ঠান হয়, সরকারের কথা বলছি না, বেসরকারি পর্যায়ে, যেমন বিয়ে, জন্মদিন, বউভাত, গায়েহলুদ—সব আমন্ত্রণপত্র ইংরেজিতে লেখা হয় এবং সেটা শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত–নির্বিশেষে। এখন এর জন্য আমরা কাকে দোষ দেব? ১৯৪০ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সব মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করে দেওয়া হয়। কিন্তু তখনো ইন্টারমিডিয়েট ও কলেজ লেভেলে ইংরেজি মাধ্যম প্রচলিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ইংরেজি মাধ্যম ছিলই। কিন্তু সে অবস্থায়ও আমরা দেখেছি, সেকালে সব বিয়ের আমন্ত্রণপত্র বাংলায় লেখা হতো এবং বিেয় উৎসবে একটা কবিতা পাঠ করা হতো।
দ্বিতীয়ত, এই যে আমরা রোমান হরফে বাংলা লেখার বিরুদ্ধে এত আন্দোলন করেছি পাকিস্তানি জমানায়, এখন আমাদের সন্তানেরাই রোমান হরফে বাংলা লিখছে। কোন বাংলা লিখছে—আঞ্চলিক বাংলা। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করছি, কিন্তু বাংলা ভাষার এমন দুর্গতি আগে কখনো লক্ষ করিনি। শিক্ষকেরা যখন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন, তাঁরাও তখন প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেন না। কথা হচ্ছে যে ভাষার আঞ্চলিক রূপ আছে, প্রমিত রূপ আছে। যেখানে প্রমিত দরকার, সেখানে প্রমিত ব্যবহার করব, যেখানে আঞ্চলিক দরকার, সেখানে আঞ্চলিক ব্যবহার করব। কারণ, আঞ্চলিক ভাষাও আমাদের ভাষা। সমস্যাটা হলো মিশ্রণ।
একটা টেলিভিশন চ্যানেলে সপ্তাহে এক দিন ব্যান্ড শো হয়। এতে তাঁরা বাংলা গান নিজেরাই ব্যবহার করেন, নিজেরাই সুর দেন। কিন্তু তাঁরা যখন কথা বলেন, অর্ধেক ইংরেজিতে, অর্ধেক বাংলায়। মনে হয় যেন তাঁদের মাতৃভাষাটা ইংরেজি, আর এখানে তাঁরা চেষ্টা করে, কষ্ট করে বাংলা বলছেন।
ইন্টারমিডিয়েট ও কলেজে আগে ইংরেজি মাধ্যম ছিল। তখন একটা আন্দোলন হলো যে যার খুশি সে বাংলায় পরীক্ষা দিতে পারবে। এটা তখন যে বোর্ড ছিল বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তারা সেটা মেনে নিল। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজিটা রইল। তো, পাকিস্তান আমলে যদি এগুলো হয়ে থাকতে পারে, বাংলাদেশ আমলে কেন এগুলো হতে পারবে না? তার মানে এমন একটা হীনম্মন্যতা আমাদের মধ্যে কাজ করছে। আমরা উচ্চতর আদালতকে দোষারোপ করি যে তাঁরা ওখানে বাংলায় রায় দিচ্ছেন না। শুধু রায় দিলে তো হবে না, আমাদের ব্যারিস্টার সাহেবরা কি বাংলায় সওয়াল–জবাব করবেন?
কেন আমাদের বাড়ির নাম, দোকানের নামফলক বাংলায় লিখতে বলতে হবে? কেন আমাদের বিভিন্ন উৎসব–অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র বাংলায় লিখতে বলতে হবে? তাহলে এই স্বাধীনতার অর্থ কোথায়? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায়? এর একটাই উত্তর—সপ্তদশ শতকে আব্দুল হাকিম বলে গেছেন, যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সেব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।

আ ফ ম দানীউল হক
আ ফ ম দানীউল হক

আ ফ ম দানীউল হক: আমাদের প্রকৃত সদিচ্ছার অভাব আছে—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ হচ্ছে, আধুনিকতা ও বহির্বিশ্বের প্রভাব। আমাদের একটি ভাষানীতি প্রয়োজন। আমাদের কোনো ভাষা–পরিকল্পনা নেই। তাও লাগবে। ভাষা–পরিকল্পনার দুটো দিক থাকে। একটা হচ্ছে অবয়ব–পরিকল্পনা, আরেকটা মর্যাদা–পরিকল্পনা। তা এই মর্যাদার জায়গাটি আমরা এখনো স্থির করতে পারিনি। মর্যাদা এবং কার্যকারিতার মানসিকতাটা এখনো তৈরি হয়নি সরকারি–বেসরকারি সবদিক থেকেই।
‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ নিয়ে একটা কাজ করছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। এই কাজে তিনি একসময় আমার কিছু সহযোগিতা চাইলেন। সেখানে ঢুকে আমি দেখলাম, নিশ্চুপ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে আসলে বাংলা ভাষা পুরোটা কার্যকর করা সম্ভব নয়। এবং প্রয়োজনও নাকি নেই। আশ্চর্য ব্যাপার, এই দীর্ঘদিনেও সেই একই মানসিকতা রয়ে গেছে।
আজ আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন, সে আপনাকে বলবে, প্রযুক্তি ও প্রয়োগগত বাধা আছে। তারপর বলবে, সহায়–সংস্থান এবং সময়–সুযোগের অভাব আছে। আমি বলব, আসলে আবেগ ত্যাগ এবং বাস্তবতা গ্রহণের সমস্যা আছে।
বাংলা ভাষা লেখার জন্য এখন একাধিক সুন্দর বাংলা সফটওয়্যার রয়েছে। একটু চেষ্টা করলেই সেটা ব্যবহার করা যায়। যাঁরা কম্পিউটার ব্যবহার করেন, তাঁরা জানেন যে ইন্টারফেসের একটা ব্যাপার থাকে। একটা আস্কিতে চলে, আরেকটা ইউনিকোডে চলে। এখন ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম আমাদের বাংলা ভাষার সবগুলো নিয়ে নিয়েছে। প্রয়োগ ও প্রযুক্তি আসলে আমার কাছে এখন আর কোনো সমস্যা বলে মনে হয় না।

রাশেদা কে চৌধূরী
রাশেদা কে চৌধূরী

রাশেদা কে চৌধূরী: সর্বস্তর বলতে কী বুঝি আসলে। এখন পর্যন্ত আমাদের ধ্যানধারণা বা চিন্তাচেতনা প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান—এগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। আমরা কি জনমানুষ নিয়ে চিন্তা করি? যে দেশে এখনো ৩০ শতাংশ মানুষ লেখাপড়া জানে না, সেখানে প্রমিত বাংলার চর্চা কীভাবে হবে? সর্বস্তরের কথা বললে আমাদের এ বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবতে হবে।
রেডিও যে ভূমিকাটা পালন করে, বিশেষ করে এফএম রেডিও বা কমিউনিটি রেডিও। সেখানে ভাষার চরম বিকৃতি হচ্ছে। মোবাইল ফোনের মধ্য দিয়ে যে খুদে বার্তাগুলো আসছে, রোমান হরফে ইংরেজিতে বাংলা লেখা জগাখিচুড়ির একটা চূড়ান্ত। বাংলাদেশে লাখ লাখ কৃষক। আমরা কিন্তু কখনো দেখি না, কৃষি উপকরণে যে ভাষাটা ব্যবহার করা হয়, সার ইত্যাদির ব্যবহারবিধিটা ইংরেজিতে বেশির ভাগ এবং বাংলাটাও কঠিনভাবে দেওয়া হয়।
সর্বশেষ কথা হচ্ছে, তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। মূল ধারা যে বাংলা মাধ্যম, সেটাও একটা জগাখিচুড়ি এখন। ইংরেজি ভার্সন, বাংলা ভার্সন। আর শিক্ষানীতি তো বলেছিল ইংরেজি মাধ্যম অথবা ধর্মীয় মাধ্যমে ন্যূনতম পাঁচটি পাঠ্যপুস্তক পড়তে হবে। সেগুলোতে তো কোনো মনিটরিং নেই। আমরা কাদের কাছে নতিস্বীকার করছি। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কাছে। এ রকম যদি চলে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অনেক হলি আর্টিজান আমাদের মোকাবিলা করতে হবে।

মো. মোস্তফা
মো. মোস্তফা

মো. মোস্তফা: আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্যাটাগরির যে মোবাইলগুলো আসে, এর মধ্যে অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলোতে আমরা ইংরেজি–বাংলা দুটোই ব্যবহার করতে পারলেও কম দামের ফোনগুলোতে পারা যায় না। কিছু দামি ফোনে আমরা বাংলা সফটওয়্যার ইনস্টল করতে পারি। সরকারি পর্যায়ে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ফন্টও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ছয়টি ফন্টে আমাদের লিখতে বলা হয়েছে।
আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৬ সালের ৮ মার্চ একটি উদ্ভাবনীমূলক উদ্যোগ নিয়েছি। সেটা হচ্ছে ফেসবুকে যদি কেউ প্রমিত বাংলা বানানের সেবা নিতে চান, বানানের ভুল–শুদ্ধের ব্যাপারে আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি। সর্বস্তরে, সরকারি অফিসে প্রমিত বাংলার ব্যবহার হোক, এটা আমরা আন্তরিকভাবে চাই। একটি দাপ্তরিক টেলিফোন নম্বরে নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা ফোন করলে আমরা সেবা দিয়ে থাকি। নম্বরটা হচ্ছে ০২–৯৫৭০৬৬৪।
১৯৭৩, ’৭৫, ’৭৯ সালসহ বিভিন্ন সময়ে সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১৯৮৪ সালে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ ১৯টি প্রকল্প চালু করে। এর মধ্যে ১৮ নম্বর কার্যক্রমটি ছিল বাংলাদেশের সব অফিসের সাইনবোর্ড ও কর্মকর্তাদের নামফলক বাংলায় লিখতে হবে। নথিপত্রে বাংলায় লেখার সঙ্গে সঙ্গে স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর করতে হবে। আমরা যদি ওপরের দিকে তাকাই—প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি বাংলায় স্বাক্ষর করেন। এই সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার।
২০১২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটা পরিপত্র জারি করে সরকার যে আমরা বানানে সমরূপতা ও সামঞ্জস্য বিধান করার জন্য বাংলা একাডেমি প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করব। ২০১৫ সালে ‘সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলা’ নামের একটি পুস্তিকা প্রণয়ন করি। ২০১৬ সালে প্রশাসনিক পরিভাষা, পদবির পরিভাষার বই হয়েছে এবং এ বছর আমরা আরও দুটি বই প্রকাশ করব। সরকারি কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের নিয়ম এবং সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলার দ্বিতীয় সংস্করণ।

বিসিএস পরীক্ষা দুই মাধ্যমে নেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কেউ ইচ্ছে করলে বাংলা–ইংরেজি যেকোনো একটি মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে পারে।

মাহবুব–উর–রহমান
মাহবুব–উর–রহমান

মাহবুব–উর–রহমান: আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা একটু বলব। আমরা যদি জানার বিষয়টাকে পোক্ত করতে না পারি, তাহলে প্রয়োগের বিষয়টা হবে না। যারা জানবে, তারাই প্রয়োগ করতে পারবে। আর জানার পুরো বিষয়টাকে আনন্দদায়ক করে তুলতে হবে। আমরা প্রায়ই বলি, তোমাদের স্মার্ট হতে হবে। ইংরেজি জানাটাই স্মার্টনেস নয়। বাংলা না–জানাটা স্মার্ট না হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ।
আমি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, যেখানে ইংরেজি ব্যবহারই সর্বাধিক। কিন্তু তারপরও আমি বলব, যাঁরা মনে করেন বাংলা জানাটা ইংরেজি জানার সঙ্গে পরস্পরবিরোধী, তাঁদের ভাবনাটা ঠিক নয়; বরং ইংরেজি প্রয়োগ করার ব্যাপারে সুবিধা হয়, যদি বাংলা ভালোভাবে জানা যায়। একটা অনুরাগ জন্ম দেওয়ার ব্যাপার। এটা আসলে আমরা যারা এখানে আছি, তাদের সবার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। একটা হচ্ছে বিদ্যালয়, আরেকটা হচ্ছে বিদ্যালয়ের বাইরে। এই যে ভাষা প্রতিযোগের আয়োজন, বিদ্যালয়ের বাইরে এ রকম কোনো উদ্যোগ নিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা যায় কি না। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এতটুকুই বলব, প্রচণ্ড রকম একটা অনুরাগ এবং ভালোবাসা সৃষ্টি করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের। শহীদ কাদরীর নির্বাসনের একটা কবিতা পড়ছিলাম সেদিন। ‘পুকুরের যৌথস্নান থেকে নিঃসঙ্গ বাথরুম নির্বাসন কাম্য নয়’। আমরা অনেকটাই এখন নিঃসঙ্গ। আমাদের ছেলেমেয়েদের আমরা এই নিঃসঙ্গতায় না পাঠিয়ে তাদের উৎসাহ দিতে পারি যে বাংলা ভাষা জানা দরকার, এটা জানলে তোমরা অনেক স্মার্ট হতে পারবে। তোমাদেরই এটি গর্বের বিষয়। ভাষা প্রতিযোগ বিষয়টা যেহেতু বিদ্যালয়ের পর্যায়ে হয়, সেটির আলোকেই এই কথা বলা।
সাজ্জাদ শরিফ: সত্যি। আমরা ভাষা প্রতিযোগ করছি ১২ বছর ধের। প্রথমে আমরা প্রশ্ন রাখতাম শুধু পাঠ্যবইয়ের ভেতর থেকে। পর্যায়ক্রমে পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রশ্ন করাটা কমিয়ে বাইরে থেকে প্রশ্ন করা শুরু করেছি। এবং ছেলেমেয়েরা বেশ ভালোভাবে অংশগ্রহণ করছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নানা রকমের উদ্যোগ নিয়ে ছেলেমেয়েদের আগ্রহী করা যায়। এবার সেলিনা হোসেন বলবেন।

সেলিনা হোসেন
সেলিনা হোসেন

সেলিনা হোসেন: সচেতনতার বিপর্যয় আমাদের প্রবলভাবে গ্রাস করেছে। আমি গত মাসের ২৫ তারিখে গণগ্রন্থাগারের একটা সেমিনারে গিয়েছিলাম। সেখানে লন্ডন থেকে আসা বাঙালি পরিবারের ছেলে বই লিখেছে ইংরেজি ভাষায়, সেটার প্রকাশনা উৎসব। কিন্তু ছেলেটির নাম দেখে আমি থ হয়ে গেলাম। সৈয়দ আল জুবায়েল মাসুম না কী যেন একটা—কোনোভাবেই মনে হবে না যে এটি একটি বাঙালি ছেলের নাম। ছেলেটির মা বললেন, ‘আমার মা এই নামটা রেখেছেন।’ ছেলেটার নানি ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন। তিনি বরিশালের মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তাঁকে বললাম, ‘এভাবে একটি ছেলের নাম রাখলেন যে ছেলের পরিচয়টা নামের মাঝে খুঁজে পাই না!’
আমার দুটি প্রস্তাব। প্রথম আলোর কাছে প্রস্তাব—এই ফেব্রুয়ারি মাসের পর তারা পত্রিকার মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতার জন্য কোনো দায়িত্ব পালন করবে কি না। আর সাইনবোর্ডগুলো বাংলায় লিখে তারপর ছোট্ট করে ইংরেজি লেখা যায় কি না। বাংলা একাডেমির কাছে দাবি করছি যে মহাপরিচালক যদি বলেন, আমাদের সাইনবোর্ডের বানানগুলো নির্ভুলভাবে হবে, সে জন্য একাডেমি তিন থেকে পাঁচজনের একটা কমিটি করে দেবে কি না। যাঁরা সাইনবোর্ডগুলো লিখবেন, তাঁরা ওই কমিটির কাছ থেকে নির্ভুল বানানে লিখে আনবেন।
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমিতে এসে বক্তৃতা করেন। সেটি আমি শুনেছি। বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস, আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করব না। কারণ, তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনো দিনই বাংলা চালু করা সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় হয়তো কিছু কিছু ভুল হবে। কিন্তু তাতে কিছু যায়–আসে না। এভাবেই অগ্রসর হতে হবে।’ শেষে তিনি ভাষা প্রসঙ্গে আরেকটু বলেছেন, ‘মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভিতর দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না...।’
গোলটেবিলে বসে আমরা নিজেদের ব্যর্থতাকে, সামাজিক অসচেতনতাকে এভাবে চাপা দিয়ে রাখব না। আমরা মনে করি, প্রথম আলো আর এইচএসবিসি যে উদ্যোগ নিয়ে ভাষা প্রতিযোগ আয়োজন করে, সেটা নতুন প্রজন্মের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে।

মোহাম্মদ আজম
মোহাম্মদ আজম

মোহাম্মদ আজম: আমি নিজে ১০ বছর ধরে বলি আর লিখি। প্রথমেই আমি এই আলোচনা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে চাই। এখানে সবাই বাংলার লোক কেন? এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এখানে বাংলার চর্চাটা হচ্ছে না। লোকে মনে করে, এটা বাংলার ব্যাপার। আসলে এটা বাংলার ব্যাপার নয়। আমরা উনিশ বা বিশ শতকের বাংলাচর্চার যে প্রশংসা করি, সেটার মধ্যে একটা ব্যাপার উল্লেখই করি না। সেটা হচ্ছে যে উনিশ ও বিশ শতকের গোড়ায় বাংলাকে আসলে সাহিত্যের ভাষা হিসেবেই দেখা হয়েছে। এবং ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় তাঁরা সেটা করতে বাধ্য ছিলেন। কারণ, তাঁদের রাষ্ট্র চালানোর ও রাজনীতি করার ক্ষমতা ছিল না। ওই যে সাহিত্যেই বাংলা ব্যবহৃত হবে, এই চিন্তাটাই আমাদের মধ্যে অত্যন্ত প্রবল। এটা আমাদের অন্য অনেক সমস্যার গোড়ায় গভীরভাবে কাজ করছে।
পরিভাষা নিয়ে আমাদের চিন্তা অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন। পরিভাষা করার ক্ষেত্রে বাংলার শিক্ষকের কোনো সম্পর্ক নেই। পরিভাষা একটা চর্চার বিষয় এবং যে বিষয়ে চর্চা করছে, তার ভেতর দিয়ে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরিভাষা তৈরি হতে পারে। আমাদের এখানে একেবারেই উল্টো কথা চালু আছে। বাংলা একাডেমির এ ব্যাপারে বহু কাজ। সংস্কৃতায়িত শব্দে বাংলা পরিভাষাগুলো ভরিয়ে তুলেছে। এবং সেটা কেউ ব্যবহার করে না। পরিভাষার যোগ বাংলা ভাষার সঙ্গে নয়, বিষয়ের সঙ্গে।
আমাদের প্রমিত বাংলা সাংঘাতিক রকমের জনবিরোধী। কৃষকদের উপযোগী এক অনুচ্ছেদের বর্ণনা তৈরির করার ক্ষমতা আমরা যারা প্রমিত বাংলা চর্চা করি, তারা হারিয়েছি। আমাদের ভাষা আসলেই জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। আমরা এখন কার কাছে বাংলা ভাষা চাই? আমরা চাইলেই তো বাংলা চালু করতে পারি। করি না কেন? এতে আমার ধারণা, আমাদের শাসকশ্রেণির একটা হীনম্মন্যতা আছে। এবং প্রতারণামূলক একটা ব্যাপার আছে। আমাদের শাসকশ্রেণির ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে। এটা নিয়ে কথাবার্তা কম হয়।
যে ছেলেমেয়েরা বাংলা–ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে, ওরা একটা ব্যবস্থার ফল মাত্র। ওদের সমালোচনা করে তো লাভ নেই। আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ইংরেজির হাতে ছেড়ে দিয়েছি। কোনোভাবে ক্ষমতা আছে, সমাজের এমন একটা অংশও বাংলায় পড়াশোনা করে না। বাংলার সমস্যাটা দেশে একটা কাঠামোগত সমস্যা। ওই কাঠামো প্রধানত নির্ভর করে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। বাদবাকি আমরা যে আবেগ প্রকাশ করছি, আমি সেটাকে একটা প্রতারণামূলক অবস্থান বলব।
আমাদের দেশের ১৬ কোটি লোকের বিরাট বাজার। কোনো মোবাইল সেট যখন বিদেশ থেকে আসবে, সেটা বাংলায় হতে হবে। এটা সরকারের একটা আদেশই যথেষ্ট। ওই কোম্পানি নিজের গরজে করবে।
আমরা বাংলার পক্ষে যুক্তি দিয়েছি আবেগ দিয়ে। আর ইংরেজি সব সময় বাজার, প্রয়োজন, এলিটিজমের কথা বলে। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন করতে হবে রাষ্ট্রের জন্য। আপনি যদি গণতন্ত্র চান, এটা হতেই হবে। আপনি যদি উন্নতি চান, ১৬ কোটি মানুষ নিয়ে উন্নতি করবেন, তাহলে আপনার বাংলা লাগবেই। আপনি যদি সত্যি সত্যি শিক্ষা চান, বাংলা লাগবেই। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে উচ্চশিক্ষায় বাংলাকে অবশ্যই চালু করতে হবে। আপনি যদি বিদেশে স্থায়ী হতে চান, সে জন্য আপনি ইংরেজি পড়তে পারেন। আপনি বিশ্ববাজারে শ্রমিকগিরি করবেন, ইংরেজি পড়তে পারেন। কিন্তু আপনি যদি ব্যবসা বোঝান, আপনি যদি শিক্ষা বোঝান, আপনাকে অবশ্যই ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত—সর্বস্তরে বাংলায় করতে হবে।

সৌরভ সিকদার
সৌরভ সিকদার

সৌরভ সিকদার: প্রতিবছরই আমরা দেখি বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে ঈদের সময়ে আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অনেক নাটক প্রচার করে। সেগুলোর বিজ্ঞাপন বের হয়। এই বিজ্ঞাপনগুলো যদি আপনি দেখেন, গত বছরের ১৭টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ১২টির নামই ইংরেজিতে। টিভি চ্যানেলের ২২০টি নাটকের মধ্যে প্রায় ১৭০টি নাটকের নাম ইংরেজিতে। আমাদের আলু ভর্তা, ডাল–ভাত বাদে প্রায় সব খাবারের দোকানের নামই ইংরেজিতে।
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিমান ও প্রযুক্তি, উচ্চশিক্ষার কিছু ক্ষেত্র বাদে বাকি জায়গাগুলোতে বাংলা ভাষা প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। আমার তো মনে হয়, সরকার একটু উদ্যোগ নিলেই সব পারে। বিদেশ থেকে শুধু মোবাইল নয়, অন্য পণ্য যারা বিক্রি করে বা ব্যবসা করে বাংলাদেশে, তাদের আমরা বাধ্য করতে পারি যে পণ্যগুলোর বাংলায় নাম আসবে। সেটা সম্ভব। আসলে সমস্যাটা অন্য জায়গায়। চানাচুর ভাজা বাদ দিলে, সেটাও রোমান হরফে চলে গেছে, যত পণ্য আছে তার সবই ইংরেজি নামে চলে আসছে। ১৯৮৪ সালে যখন সামরিক সরকার ক্ষমতায়, সেই সময় নির্বাহী আদেশ দিয়ে বলা হয়েছে যে সব সাইনবোর্ড ও গাড়ির নামফলক বাংলায় হতে হবে। এবং যদি প্রয়োজন মনে করেন, নিচে ছোট করে ইংরেজিতে লেখা যেতে পারে। এই আইন করে দেওয়া আছে। আইনের কোনো প্রয়োগ নেই।
সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে হবে, যাতে করে আমরা ভাবতে পারি, বিয়ের কার্ড বা সন্তানের জন্মদিনের চিঠি বাংলায় হলে মানুষ তা গ্রহণ করবে। গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা খুবই প্রয়োজন। শিক্ষার প্রসঙ্গটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রমিত বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভাষা–পরিকল্পনা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমাদের শিক্ষানীতি আছে, আমরা কি একটা ভাষানীতি করতে পারি না? এই জিনিসগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাবতে হবে।
ইংরেজি শিখলে লাভ—সে জন্যই আমাদের সন্তানেরা ইংরেজি শিখতে চায়। বাংলা শিখলে কী কী লাভ, কোথায় কোথায় সেই সুবিধা পাবে—এ কথাটা রাষ্ট্র যদি স্পষ্ট করে বলতে পারে, তাহলে আর আইন করতে হবে না। এমনিতেই বাংলা সর্বস্তরে প্রচিলত হবে।

বিশ্বজিৎ ঘোষ
বিশ্বজিৎ ঘোষ

বিশ্বজিৎ ঘোষ: বাংলাদেশে বাংলা ভাষার অবস্থা এখন স্বদেশে পরবাসীর মতো। সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে যে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। অন্যদিকে ১৯৭৮ সালে পরিপত্র বিজ্ঞাপিত হয়েছিল, ‘যদি সংবিধান–সংক্রান্ত কোনো গোঁজামিল দেখা দেয়, ব্যাখ্যার দরকার হয়, তাহলে ইংরেজি প্রাধান্য পাইবে।’ পরে তা সংশোধন করা হয়েছে। ‘সর্বস্তরের বাংলা প্রচলন হইবে’ ১৯৭৮ সালে যে পরিপত্রটি হয়েছিল, তা ইংরেজিতে। এই যে নতুন একটি ইংরেজি শিক্ষিত এলিট শ্রেণির জন্ম হয়েছিল, সেটির ধারাবাহিকতা এখনো আছে। তাহলে ভেতরে–ভেতরে এই জিনিসটি কাজ করেছে দীর্ঘদিন ধরে।
শিক্ষার সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। বাংলা বিভাগ ছাড়া অন্য কোনো বিভাগের প্রশ্ন এখন বাংলায় করা হয় না। এতে পাবলিক আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হেরফের নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সেখানকার শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের বলেন, বাংলায় লিখলে নম্বর পাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ছাড়া আর কোনো বিভাগে এখন রেফারেন্স বই বাংলায় থাকে না। দু–একটি জায়গায় আছে। ১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৮৩৫ থেকে ১৮৬৯ পর্যন্ত সব বক্তৃতা বাংলায় দেওয়া হতো। শিক্ষার্থীরাও বাংলায় লিখে পাস করতেন। যদি ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত বাংলায় চিকিৎসাশাস্ত্র পড়া যায়, এখন পারা যাবে না কেন? আমরা অাঠারো শতকের শেষের দিকে অথবা উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যাই, জোনাথান ডানকান অথবা ফস্টার সব আইন বাংলায় অনুবাদ করিয়েছেন মুনশিদের দিয়ে। যদি ২০০ বছর আগে বাংলা ভাষায় আইন করতে পারে ব্রিটিশরা, তাহলে আজ বাংলায় করা যাবে না কেন? আসলে আমাদের সদিচ্ছার অভাব। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
বাংলা ভাষা পুঁজিবাদের শিকার। দেশে যাঁরা রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা করেন, তাঁদেরও অবহেলার শিকার। হ্যাঁ, কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনে আমরা ইংরেজি শিখব। কিন্তু মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে কখনোই অন্য ভাষা ভালো করে শেখা যায় না। উদ্ভট এক সংস্কৃতির মধ্যে আমরা পড়েছি। এই জায়গা থেকে জনবিচ্ছিন্ন ভাষা হয়ে গেছে বাংলা। যেটি আজম বলার চেষ্টা করেছেন যে লোকায়ত মানুষের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং লোকভাষাটাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এই জায়গা থেকে যদি দাঁড়াতে হয়, তাহলে সর্বস্তরের বাংলা ভাষা বাস্তবায়নের জন্য একটা কমিটি থাকা দরকার। সহায়ক কমিটির কথা আমি বলছি, তারা এটির কাজ করবে। ভাষানীতি থাকা দরকার। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বানানের কথা বলো? বানান যদি ঠিক করতে হয়, তাহলে কামাল পাশার মতো একজন শাসক দরকার। অনুমান করি, রবীন্দ্রনাথ কামাল পাশা বলতে একজন রাষ্ট্রীয় প্রশাসককে বুঝিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বলুক, এক মাসের জন্য দোকানের নাম বড় বাংলার নিচে ইংরেজিতেও একটু থাকবে ছোট করে। নতুবা ৫০ হাজার টাকার দণ্ড দিতে হবে। বাংলা একাডেমির সেল লাগবে না, এক মাসেই সব বানান ঠিক হয়ে যাবে। এটা বাংলা একাডেমির দায়িত্ব নয়, এটা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। অত্যাচার, উৎপীড়ন, বাধা, অন্য হরফে লেখা এগুলো থাকবেই, কিন্তু এর মধ্য থেকে যুদ্ধ করেই বাংলা ভাষাকে টিকে থাকতে হবে।

শামসুজ্জামান খান
শামসুজ্জামান খান

শামসুজ্জামান খান: প্রায় সব বিষয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। প্রথম কথা হলো, সবকিছুই বাংলা একাডেমি দেখবে না। সরকারি কোনো সংস্থাকে দায়িত্বটা নিতে হবে। সর্বস্তরের কথাটার ব্যাখ্যাও বুঝতে হবে। সর্বস্তর মানে প্রশাসন, আইন–আদালত, শিক্ষাক্ষেত্র, চিকিৎসা, প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য, প্রকৌশল এবং আনুষ্ঠানিক সভা–সমিতি। জার্মানের বিখ্যাত এক পণ্ডিত বাংলাদেশে এসেছিলেন কৃষি নিয়ে কাজ করতে, অভিভূত হয়েছিলেন। কৃষকদের শব্দ তৈরি করতে কোনো কষ্ট হয় না, নানা শব্দ তাঁরা তৈরি করেন। তিনি দেখালেন যে নদীর একটা জায়গায় কোণ হয়ে গেছে। তিনি বলছেন, ‘আমি তো জানি না ইংরেজিতে এই শব্দ কী হবে।’ তখন একজন কৃষক বললেন, ‘এটা স্যার, গাঙ্গের ঠেস।’ এটাকে প্রমিত করার দরকার নেই। সব লোক কখনো প্রমিত বাংলায় কথা বলবে না। প্রমিত বাংলা ব্যবহৃত হবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে।
সরকারের এক মাসের সিদ্ধান্তে এই বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে প্রমিত বাংলার প্রয়োগ নিশ্চিত হতে পারে। করণীয় এসব ক্ষেত্র সরকারি দপ্তরের অন্তর্ভুক্ত। অতএব যদি কোনো সরকার সুস্পষ্টভাবে চায় তো এটা হতে পারে। আমি অনুমান করি, বঙ্গবন্ধু থাকলে এটা এত দিনে হয়ে যেত। আমরা এটা করতে পারছি না। তার কারণ, এই জায়গায় নানা রকমের লাভ–ক্ষতির সম্পর্ক আছে।
আমি যতটুকু বুঝেছি, বাংলা ভাষা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা মগদের। আরাকান রাষ্ট্র ও বাংলা সাহিত্য হয়েছে মগের অঞ্চেল। মগ বলতে যাদের বোঝানো হয়েছে, মগধ থেকে আসা। এটা নিয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে। মগ, চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ—এসব অঞ্চলের লোকেরা বাংলা ভাষাকে যদি না–ই ভালোবাসত, তাহলে বাংলা ভাষা টিকে থাকত কি না—সন্দেহ আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যচর্চা, মধ্যযুগের ওই অঞ্চলের লোকেরা করেছে। ষোড়শ শতাব্দীতে সৈয়দ সুলতান, সপ্তদশ শতাব্দীতে আব্দুল হাকিমকে কেন বলতে হয়েছিল, বাংলা ভূমিতে বাস করে যারা বাংলাচর্চা করে না, তারা জারজ সন্তান। তাতেই বোঝা যায়, বাংলাবিরোধিতা সব সময়ই ছিল এবং এখনো আছে। সে জন্য আমি একটুও ভয় পাই না। বাংলা ভাষাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
সবদিক থেকেই সিভিল প্রশাসন ও সরকারের দায়িত্ব বেশি। সরকারের এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পণ্ডিতদের প্রমিত বাংলাচর্চার ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যারা নানা দায়িত্বে আছি, আমাদের দায়িত্বও অনেক। আমাদের সন্তানদের আমরা ইউরোপ, আমেরিকায় পড়াচ্ছি। তাদের কাছ থেকে আমরা আর কী আশা করতে পারব! আমরা মধ্যবিত্তরা সবচেয়ে সুবিধাবাদী। আমরা আশা করব, মধ্যবিত্ত সমাজসচেতন হবে।

সাজ্জাদ শরিফ: আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

যাঁরা অংশ নিলেন
১. রফিকুল ইসলাম : নজরুল–গবেষক ও ভাষাবিজ্ঞানী
২. শামসুজ্জামান খান : মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
৩. রাশেদা কে চৌধূরী : নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান
৪. সেলিনা হোসেন : কথাসাহিত্যিক
৫. আ ফ ম দানীউল হক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
৬. বিশ্বজিৎ ঘোষ : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৭. মাহবুব–উর–রহমান : উপপ্রধান নির্বাহী অফিসার ও হেড অব কমার্শিয়াল
ব্যাংকিং প্রধান, এইচএসবিসি, বাংলাদেশ
৮. সৌরভ সিকদার : অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৯. মোহাম্মদ আজম : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১০. মো. মোস্তফা : অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
সাজ্জাদ শরিফ : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, প্রথম আলো