সাইক্লিংয়ে নিঃসঙ্গ শেরপা

সাইকেল নিয়ে কঠোর অনুশীলন রাকিবুলের রোজকার রুটিন কাজ
ছবি: সংগৃহীত

সাইক্লিং তাঁর ধ্যানজ্ঞান। নেশা, পেশা—সবই তাঁর সাইকেলকে ঘিরে। সাইক্লিংয়ের নেশায় চাকরি ছেড়েছেন। ছেড়ে চলে গেছেন ঢাকা শহর। সাইক্লিংয়ের জন্য যেমন তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা, তেমনি সেই সাইকেলও তাঁকে এনে দিয়েছে একের পর এক পদক, যশ-খ্যাতি।

সাইক্লিং নিয়ে জাতীয় যত আয়োজন, সেগুলোয় এত দিন বিভিন্ন বাহিনীর আধিপত্য ছিল বেশি। এবারই প্রথম সাইকেল নিয়ে জাতীয় কোনো প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক গেল সাধারণ মানুষের (নন-প্রফেশনাল) কাতারে। জাতীয় সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় ইন্ডিভিজ্যুয়াল টাইম ট্রায়ালে এবার সোনা জিতেছেন রাকিবুল ইসলাম। দেশে-বিদেশে নানা প্রতিযোগিতায় এরই মধ্যে ১১টি পদক পেয়েছেন ২৯ বছরের এই তরুণ।
গত বছর বাংলাদেশ গেমসে সোনা জিতে আর সাইক্লিংয়ে বিশ্ব রেকর্ড করে সবার নজর কেড়েছিলেন চট্টগ্রাম (জেলা) ক্রীড়া সংস্থার হয়ে দুই চাকায় ঝড়তোলা রাকিবুল।
চট্টগ্রামের হয়ে খেললেও প্রতিযোগিতামূলক সাইক্লিংয়ে রাকিবুলের হাতেখড়ি কিন্তু ঢাকাতেই। একসময় এভারকেয়ার হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট ছিলেন। কিন্তু সাইক্লিস্ট হওয়ার নেশায় সেই ভালো মাইনের চাকরি আর করা হলো না। শুধু কি চাকরি! ঢাকার আবাসও গুটিয়েছেন এই সাইকেলের নেশায়। এখন তিনি পুরোদস্তুর খাগড়াছড়ির বাসিন্দা।

সোনা জেতা সেই প্রতিযোগিতা

গত ২৭ মে ৪১তম জাতীয় সাইক্লিং প্রতিযোগিতার দুই দিনের আসরটা বসেছিল গোপালগঞ্জে। শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গোলাবারি থেকে পয়সারহাটে সাইকেলের খেলায় মেতেছিলেন রাকিবুলেরা। ইন্ডিভিজ্যুয়াল টাইম ট্রায়ালে মোট প্রতিযোগী ছিলেন ১৪ জন। এর মধ্যে রাকিবুল ৪৬ মিনিট ১৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

প্রতিযোগিতায় জিততে রাকিবুলকে গড়পড়তা ৩৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার বেগে সাইকেল চালাতে হয়েছিল পয়সারহাটের সেই রাস্তায়। তবে রাস্তার অবস্থা আরেকটু ভালো হলে আর ট্রাফিক কম থাকলে আরও ভালো করতে পারতেন বলে বিশ্বাস রাকিবুলের। খুশির খবর আরও আছে। এবার জাতীয় পর্যায়ে দলীয় প্রতিযোগিতায়ও রাকিবুলদের চারজনের টিম ব্রোঞ্জ জিতেছে। সে দলে রাকিবুল ছাড়াও ছিলেন দ্রাবিড় আলম, রাফাত মজুমদার ও শাহাদাত হোসাইন।

কথা প্রসঙ্গে সাইক্লিং ফেডারেশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন রাকিবুল। কারণ, ফেডারেশন তাঁকে সাইক্লিংয়ে সহায়তা করার জন্য একটা অনুরোধপত্র দিয়েছে। নানা উটকো ঝামেলায় এটা দেখিয়ে পার পান রাকিবুল।

একজন ফিটনেস কোচ

ঢাকায় থেকে নিবিড় অনুশীলনটা হচ্ছিল না। তাই গত বছরের সেপ্টেম্বরে খাগড়াছড়ি চলে যান রাকিবুল। শহরের মহাজনপাড়ার একটা বাসায় ওঠেন এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে। সপ্তাহে ২০-৩০ ঘণ্টা ট্রেনিং করেন। সাইকেল চালান আর রোজ দৌড়ান।
রাকিবুল নিজে একজন ফিটনেস কোচ। সাইক্লিংয়ে কোচ হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন ভারত থেকে। এ ছাড়া রোজকার জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে যাঁরা সচেতন, তাঁরা অনলাইনে প্রশিক্ষণ আর পরামর্শ নেন রাকিবুলের কাছ থেকে। রোজ নিয়ম করে বেলা তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে পরামর্শ দেন। কাজটা অবশ্য টাকা নিয়েই করেন। এটাই এখন তাঁর আয়ের মূল উৎস।

নির্জন পাহাড়ে একলা লাগে না? জানতে চাই রাকিবুলের কাছে। একগাল হেসে বলেন, পাহাড় থেকে পাহাড়ে সাইকেল চালাতে চালাতে অনেক সময় সঙ্গে থাকা বোতলের পানি ফুরিয়ে যায়। তখন পাহাড়ি মানুষজন নিজে থেকেই পানি নিয়ে দৌড়ে আসেন। আর বাচ্চারা তাঁকে খুব ভালোবাসে।

জাতীয় সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় ইন্ডিভিজ্যুয়াল টাইম ট্রায়ালে এবার সোনা জিতেছেন রাকিবুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

এ ছাড়া খাবারদাবারে কঠোর নিয়ম মেনে চলেন রাকিবুল। তাই নিজের খাবার নিজেই রাঁধেন। সপ্তাহে দুই দিন নিজে বাজার করেন। সকালের নাশতায় থাকে ছাতু, কলা আর মিল্ক পাউডার। দুপুরে মুরগি, সামুদ্রিক মাছ আর লাল চালের ভাত। এটা তাঁর দিনের মূল খাবার। রাতে সবজি, মাঝেমধ্যে টক দই। স্থানীয় ফলমূলও খান। জুমের ফসল শুরুতে খেতে পারতেন না। এখন সয়ে গেছে।

২০১৮ সাল থেকে প্রতিযোগিতামূলক সাইক্লিং করছেন। সামনে যেতে চান আরও দূর। কঠিন সে যাত্রা, বন্ধুর পথ। সে পথ পাড়ি দিতে পাহাড়টাকে তাই কাছে টেনে নিয়েছেন। পাহাড়ও তাঁকে আপন করে নিয়েছে। এমনটাই মনে করেন পাহাড়ে সাইক্লিংয়ে নিঃসঙ্গ এই ‘শেরপা’ ।