সাকা চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ
মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ মঙ্গলবার এ আদেশ দেন।
বিএনপির কোনো নেতার বিরুদ্ধে এটাই এ ধরনের মামলায় প্রথম রায়। এর আগে সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে জামায়াতের ছয়জন নেতার বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হয়েছে।
সাকা চৌধুরীর মামলায় রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের তৃতীয় মামলার রায় ঘোষণা করলেন। আর দুই ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে এটি সপ্তম রায়।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ১৪টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ৩ (নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যা), ৫ (সুলতানপুর বণিকপাড়া গণহত্যা), ৬ (উনসত্তরপাড়া গণহত্যা) ও ৮ (আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মোজাফফর আহমেদকে অপহরণের পর হত্যা) নম্বর অভিযোগে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
এ ছাড়া ২, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে ২০ বছর করে ৬০ বছর এবং ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে পাঁচ বছর করে ১০ বছর করাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা ১, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৯, ২০, ২১, ২২ ও ২৩ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
রায় পড়ার সময় সারাক্ষণই সাকা চৌধুরী হাসছিলেন। তিনি বিভিন্ন মন্তব্য করছিলেন। ৩ নম্বর অভিযোগ পড়ার সময় তিনি বলেন, ‘৩০ লাখ তো মারা গেছে। বলে দিলেই হয়, আমি ২০ লাখ মেরেছি।’
একপর্যায়ে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘রায় তো গতকালই ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে।’
এই বিএনপি নেতা আবার বলেন, ‘এই রায় এখান থেকে হয়নি। এই রায় বেলজিয়াম থেকে এসেছে।’
আজ সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে তিন বিচারপতি ট্রাইব্যুনালে আসেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এ টি এম ফজলে কবীর বলেন, ‘আজ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের দিন। রায়টি সংক্ষিপ্ত আকারে আমরা পড়ব। সংক্ষিপ্ত রায়টি ১৭২ পৃষ্ঠার।’
রায়ের প্রথম অংশ পড়েন বিচারপতি আনোয়ারুল হক। দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। দণ্ড ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এ টি এম ফজলে কবীর।
সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে সাকা চৌধুরীকে হাজতখানা থেকে ট্রাইব্যুনালে আসামির কাঠগড়ায় আনা হয়। তাঁর পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা ও চামড়ার স্যান্ডেল। হাজতখানা থেকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় আনার সময় পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে সাকা চৌধুরীকে হাসিতামাশা করতে দেখা যায়। তিনি অট্টহাসিও হাসেন।
এর আগে সকাল ১০টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সাকা চৌধুরীকে প্রিজনভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। শিশু একাডেমীর পাশে ট্রাইব্যুনালের গেট দিয়ে তাঁকে ঢোকানো হয়। এ সময় উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে হাত নাড়েন তিনি। সেখান থেকে তাঁকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নেওয়া হয়। আদালতে তাঁর স্ত্রী ফরহাত কাদের ও মেয়ে ফারজিত কাদের চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল সোমবার ট্রাইব্যুনালের কার্যতালিকার ৪ নম্বরে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলায় আদেশের জন্য নির্ধারিত হয়। বেলা সোয়া ১১টার দিকে ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেন, এই মামলার রায় প্রস্তুত হয়েছে। কাল মঙ্গলবার তা ঘোষণা করা হবে।
গতকাল বিকেলে সাকা চৌধুরীকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।
সর্বাধিক অভিযোগ: ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বা বিচার শেষ হওয়া যেকোনো মামলার তুলনায় এটি সবচেয়ে বড় কলেবরের মামলা। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সর্বোচ্চসংখ্যক ২৩টি অভিযোগ গঠন করা হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০টি অভিযোগ ছিল জামায়াতের নেতা সাঈদীর বিরুদ্ধে।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা ২৩টি অভিযোগের নয়টি গণহত্যার। মুক্তিযুদ্ধকালে রাউজানের মধ্যগহিরা, জগত্মল্লপাড়া, উনসত্তরপাড়া, শাকপুরা প্রভৃতি গ্রামে গণহত্যা ছাড়াও সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অন্যতম আলোচিত অভিযোগ কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যার।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ অনুসারে, চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন সাকা চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি গুডস হিল একাত্তরে ছিল একটি নির্যাতনকেন্দ্র। অনেক ব্যক্তিকে সেখানে ধরে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। এ ছাড়া হিন্দু জনগোষ্ঠীকে নিপীড়নে পাকিস্তানি সেনাদের সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ও রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দি অনুসারে, একাত্তরের ১৩ এপ্রিল কুণ্ডেশ্বরীতে নিজ বাসভবনে নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যার সময় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সাকা চৌধুরী ছিলেন এবং তিনি নিজেও হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন।
সর্বাধিক সাক্ষী: সর্বাধিক অভিযোগের মতো সর্বাধিক সাক্ষীও এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। মোট সাক্ষী ছিলেন ৪৫ জন। গত বছরের ১৪ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। প্রায় সোয়া এক বছর ধরে চলা সাক্ষ্য গ্রহণকালে রাষ্ট্রপক্ষে একে একে সাক্ষ্য দেন শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ছেলে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ ও ভাতিজা গৌরাঙ্গ সিংহ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সালেহ উদ্দিনসহ কয়েকজন ভুক্তভোগী ও শহীদ পরিবারের কয়েকজন সদস্য। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নূরুল ইসলামকে দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষে ৪১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় চলতি বছরের ১৩ জুন।
সাকা চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য এক হাজার ১৫৩ জন সাক্ষীর দীর্ঘ তালিকা জমা দিয়েছিলেন তাঁর আইনজীবীরা। ট্রাইব্যুনাল ওই তালিকা থেকে পাঁচজনকে সাক্ষ্য দেওয়ার অনুমতি দেন। আসামিপক্ষের প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন আসামি সাকা চৌধুরী নিজেই। পরে তাঁর পক্ষে আরও তিনজন সাক্ষ্য দেন।
সাকা চৌধুরী দাবি করেন, একাত্তরের ২৯ মার্চ তিনি ঢাকা ছেড়ে করাচি চলে যান; এরপর ঢাকায় ফিরেছেন ১৯৭৪ সালে। আসামিপক্ষের অন্য সাক্ষীরাও একই ধরনের জবানবন্দি দেন।
যেভাবে বিচার শুরু: ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ১৭ নভেম্বর তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ তাঁর বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন। ওই বছরের ১৪ মে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এরপর দীর্ঘ প্রায় ১৫ মাস ধরে চলা সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় চলতি বছরের ২৪ জুলাই। এ সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন ৪১ জন, আসামিপক্ষে চারজন।
দুই পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে গত ২৮ জুলাই যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। সাকা চৌধুরীকে অপরাধী দাবি করে সর্বোচ্চ সাজার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি এবং তাঁকে নিরপরাধ দাবি করে খালাসের জন্য আসামিপক্ষের পাল্টা যুক্তি শেষ হয় গত ১৪ আগস্ট। ওই দিন ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, যেকোনো দিন রায় ঘোষণা করা হবে। আজ সেই রায় ঘোষণা করা হলো।
নিরাপত্তা: সাকা চৌধুরীর রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পুরোনো হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্ট ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের দুটি প্রবেশপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। ওই এলাকায় টহল দিচ্ছে পুলিশের সাঁজোয়া গাড়ি। লোকজনকে তল্লাশি করে ট্রাইব্যুনালের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে।
নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে সাকা চৌধুরীর বাড়ি চট্টগ্রামেও।
তদন্ত সংস্থা জানায়, রায় ঘোষণা হবে—জানার পর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বসবাসের এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের কোতোয়ালি, রাউজান, পাঁচলাইশ, হাটহাজারী ও বোয়ালখালী—এই পাঁচটি থানা সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগসংশ্লিষ্ট এলাকা। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ও ভুক্তভোগীরা এসব এলাকায় বসবাস করেন। এ জন্য এসব এলাকার নিরাপত্তা বিশেষভাবে বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আলোচিত মামলা: এটি ট্রাইব্যুনালের অন্যতম আলোচিত মামলা। বিচার চলাকালে নানা মন্তব্য ও বক্তব্য দিয়ে সব সময় আলোচনায় ছিলেন সাকা চৌধুরী। বিচারকের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, আসামির কাঠগড়ায় বসে বিচারকাজ, সাক্ষী ও চলমান রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করা, আইনজীবীকে বাদ দিয়ে নিজেই মামলা পরিচালনা করা—বিচার চলাকালে এজলাসে এমন বহু ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। তাই আজ সবার দৃষ্টি ছিল ট্রাইব্যুনালের দিকে।
অন্য মামলা ও রায়: মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত দুই ট্রাইব্যুনালে এর আগে রায় হওয়া ছয়টি মামলার আসামি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ও বর্তমান নেতারা। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা দুটির রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-১। আর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দলটির দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং জামায়াতের সাবেক সদস্য (রুকন) পলাতক আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-২। রায়ে গোলাম আযম ও কাদের মোল্লা ছাড়া বাকি সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে নিষ্পত্তি হওয়া একমাত্র আপিলে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। অন্য মামলাগুলো এখনো আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।