সাগরকন্যা ডাকছে ওই

পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। ছবি: শংকর দাশ
পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। ছবি: শংকর দাশ

কার্তিকের পূর্ণিমার তিথি পেরিয়ে সূর্য উঠলে পুণ্যস্নানের যে ঐতিহ্য, তা আজও আছে এই সৈকতে। পেছনে কেওড়া, ছৈলা, তাল, বাবলা, বাইনগাছে ঘেরা ঘন বন। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রাখাইন সংস্কৃতির এই এলাকায় একটু তাকালে চোখে পড়বে বন বিভাগের অপূর্ব ঝাউবাগানটা। উঁকি মেরে কখনো সুদর্শন হরিণের দেখাও মিলতে পারে এখানে।

এই সৈকতে ভোর হলেই সাগর ভেদ করে অপরূপ বর্ণচ্ছটায় উঠে আসে সূর্য। আর সন্ধ্যায় সাগরজলে রঙের আভা ছড়িয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় দিনমানের রবি। মনোরম এসব নিয়ে যেন বুক চিতিয়ে আছে পটুয়াখালীতে বঙ্গোপসাগরের তীরের সাগরকন্যা কুয়াকাটা সৈকত।

কুয়াকাটা সৈকতে বালু নিয়ে খেলছে দুই শিশু। ছবি: শংকর দাশ
কুয়াকাটা সৈকতে বালু নিয়ে খেলছে দুই শিশু। ছবি: শংকর দাশ

যেখানে সাগরকন্যা
পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে ৭২ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরে কুয়াকাটা। এটি কলাপাড়া উপজেলায় পড়েছে। উপজেলা শহর থেকে দক্ষিণে ২২ কিলোমিটার কুয়াকাটার পশ্চিমে আছে আন্ধারমানিক নদের মোহনা, ফাতরার বন, সখিনার সি-বিচ, পূর্ব দিকে চরগঙ্গামতী ও আগুনমুখা নদীর মোহনা।

জনশ্রুতি আছে, এই কুয়া থেকেই কুয়াকাটা নামটি এসেছে। ছবি: শংকর দাশ
জনশ্রুতি আছে, এই কুয়া থেকেই কুয়াকাটা নামটি এসেছে। ছবি: শংকর দাশ

কুয়া থেকে কুয়াকাটা
প্রাচীন একটি কুয়া থেকে কুয়াকাটা নামটির উৎপত্তি। ১৭৮৪ সালে উপকূলীয় এলাকায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রাখাইনদের আগমন ঘটে। বর্মি রাজার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আরাকানের মেঘবতী অঞ্চল থেকে ১৫০টি রাখাইন পরিবার ৫০টি বড় নৌকা নিয়ে গলাচিপা উপজেলার জনমানবশূন্য রাঙ্গাবালীতে আশ্রয় নেয়। পরে তারা আশপাশে ছড়িয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। বিশুদ্ধ পানির জন্য তারা একটি কুয়া খনন করে। পরে এই কুয়া থেকেই কুয়াকাটা নামটি প্রচলিত হয় বলে জনশ্রুতি আছে। কুয়াটি এখনো আছে।

ফাতরার বনের ছায়া এসে পড়ে এই খালের টলটলে জলে। ছবি: শংকর দাশ
ফাতরার বনের ছায়া এসে পড়ে এই খালের টলটলে জলে। ছবি: শংকর দাশ

চোখ মেলে দেখি
১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ কুয়াকাটা সৈকতে দেখার জন্য সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য পুরোপুরি দেখা যায়। সৈকতের পূর্ব প্রান্তের চরগঙ্গামতী থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য ভালো দেখা যায়। যেন মনে হবে—এই তো, কয়েক হাত দূরেই সূর্য উঠেছে। আর পশ্চিম প্রান্তের লেম্বুরচর থেকে দেখা মিলবে সূর্যাস্তের। চরগঙ্গামতী ও লেম্বুরচরে হেঁটেও যাওয়া যায়। আরেকটু আনন্দ চাইলে লাইফবোটেও যাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া রয়েছে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল। কুয়াকাটা প্যাকেজ ভ্রমণ বোট মালিক সমিতির বোট পর্যটকদের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকে।

বোটে করে সুন্দরবনসংলগ্ন ফাতরা, লালদিয়া, হরিণবাড়িয়া, সোনাকাটা ইকোপার্কসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চলেও যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। হাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় নিলেই অপরূপ দৃশ্যের এসব স্থান ঘুরে আসা যেতে পারে। লালদিয়া এবং হরিণবাড়িয়ায় হরিণের দেখা মিলতে পারে। তবে সোনাকাটা ইকোপার্কে গেলে ছায়ার দূরত্বে হরিণ ছুটে আসতে পারে। ইচ্ছে হলে ওই সব হরিণকে নিজ হাতে খাবার খাওয়ানো যায়। হরিণেরা সেই আতিথেয়তা সাদরে গ্রহণও করে। এ ছাড়া ধারায় বুনো শুয়োর, বানর আর বনমোরগের দেখা মিলবে। ফিতরার বনানী আর তার ছায়ে এসে পড়ে ভেতরে থাকা খালের টলটলে জলে।

কুয়াকাটা সৈকত। ছবি: শংকর দাশ
কুয়াকাটা সৈকত। ছবি: শংকর দাশ

কুয়াকাটা সৈকতের পাশেই ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রাখাইনপল্লি। সেখানে একটু সময় কাটালেই রাখাইনদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক জানা যেতে পারে। হাসিখুশি স্বভাবের রাখাইনরা মিশুক প্রকৃতির। কুয়াকাটা প্রেসক্লাবের পাশেই রাখাইন কালচারাল একাডেমি। এর দক্ষিণে বৌদ্ধমন্দির ও কিংবদন্তি কুয়াটি। মন্দিরে গৌতমবুদ্ধের সোনালি রঙের সাড়ে ৩৭ মণ ওজনের বিশাল ধাতব মূর্তি আছে। তবে দেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তিটি দেখতে চাইলে মিসরিপাড়ার ঠাকুরবাড়িতে যেতে হবে। কুয়াকাটা থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে মিসরিপাড়া। রিকশাভ্যানে, অটোরিকশা বা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে চড়ে সেখানে যাওয়া যাবে।

সৈকতে এসে সমুদ্রের জলে না ঘুরে চলে গেলে আফসোস হতে পারে। তাই সমুদ্র শান্ত থাকলে সাহস করে একটু ঘুরেই আসতে পারেন। লাইফবোট নিয়ে অথবা ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে করে সমুদ্রের ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে।

কুয়াকাটা সৈকত। ছবি: শংকর দাশ
কুয়াকাটা সৈকত। ছবি: শংকর দাশ

এ ছাড়া সৈকতঘেঁষা বনাঞ্চল ঘুরে, ঘোড়ায় চরে, ভাড়ায় মোটরসাইকেল নিয়ে অথবা সূর্যস্নান করে দিব্যি সময় কাটানো যায় এই সৈকতে। টুকিটাকি শৌখিন কিছু কিনতে চাইলে রাখাইন মহিলা মার্কেটসহ বেশ কিছু দোকান আছে।

কুয়াকাটায় যাঁরা পিকনিকে যেতে চান, তাঁদের জন্য সৈকতঘেঁষা নারকেলবাগান, ঝাউবাগান, গঙ্গামতী, লেম্বুরচর এলাকায় পিকনিক স্পট রয়েছে। এ ছাড়া রাখাইনপল্লি এলাকাতেও অনেকে পিকনিক করেন।

কুয়াকাটা সৈকত থেকে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য। ছবি: শংকর দাশ
কুয়াকাটা সৈকত থেকে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য। ছবি: শংকর দাশ

পথ বলে দিই
নদী ও সড়ক—দুই পথেই কুয়াকাটা যাওয়া যায়। উড়োজাহাজে করে বরিশাল হয়েও কুয়াকাটা পৌঁছানো যায়। ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনটি বড় লঞ্চ পটুয়াখালীর উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ভোরে লঞ্চগুলো পটুয়াখালী পৌঁছায়। এরপর সকাল থেকে প্রতি ৪০ মিনিট পরপর পটুয়াখালী বাস টার্মিনাল থেকে কুয়াকাটার উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। সড়কপথে যেতে চাইলে ঢাকার গাবতলী ও সায়েদাবাদ থেকে সরাসরি বাসে যাওয়া যাবে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসও এই পথে চলাচল করে। দেশের প্রায় সব জেলা থেকেই কুয়াকাটার উদ্দেশে যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে।

কুয়াকাটা থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে মিসরিপাড়ায় রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় এই বৌদ্ধ মূর্তিটি। ছবি: শংকর দাশ
কুয়াকাটা থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে মিসরিপাড়ায় রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় এই বৌদ্ধ মূর্তিটি। ছবি: শংকর দাশ

যেখানে থাকা যাবে
কুয়াকাটায় সরকারি ও বেসরকারি মিলে ৫০টি হোটেল, মোটেল, রেস্টহাউস ও গেস্টহাউস রয়েছে। বাঁধের উত্তর পাশে রয়েছে পর্যটন করপোরেশনের মোটেল হলিডে হোমস। এ ছাড়া জেলা পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডি, সড়ক বিভাগের ডাকবাংলো রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা হলে এগুলোতে নির্ধারিত হারে ছাড় পাওয়া যাবে।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মতলেব শরিফ বলেন, এ বছর ঈদের ছুটি উপলক্ষে হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউসগুলোতে সিটের আগাম বুকিং শুরু হয়েছে।

কুয়াকাটা বৌদ্ধ মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের সোনালি রঙের সাড়ে ৩৭ মন ওজনের বিশাল ধাতব মূর্তি। ছবি: শংকর দাশ
কুয়াকাটা বৌদ্ধ মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের সোনালি রঙের সাড়ে ৩৭ মন ওজনের বিশাল ধাতব মূর্তি। ছবি: শংকর দাশ

মতলেব শরিফ বলেন, হোটেলের ননএসি সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত, ডাবল রুমের ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষের দৈনিক ভাড়া ৩০০০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত। বিভিন্ন সময় হোটেল-মোটেলগুলো পর্যটকদের জন্য বিশেষ ছাড় দেয়। এ ছাড়া কুয়াকাটায় ‘সিকদার ভিলা রিসোর্স ও গ্র্যান্ড হোটেল’ নামে পাঁচ তারকাবিশিষ্ট দুটি হোটেল রয়েছে।

সৈকতে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরছেন পর্যটকেরা। ছবি: শংকর দাশ
সৈকতে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরছেন পর্যটকেরা। ছবি: শংকর দাশ

ভাবনায় যখন নিরাপত্তা
ঈদের ছুটি উপলক্ষে সামনে এবার সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করবে। কুয়াকাটার বিভিন্ন স্পট ও দর্শনীয় স্থানে পর্যটকেরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে পারেন, তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে।

পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় কাজ করছে টুরিস্ট পুলিশ। ছবি: শংকর দাশ
পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় কাজ করছে টুরিস্ট পুলিশ। ছবি: শংকর দাশ

কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফসিউর রহমান বলেন, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য কুয়াকাটায় ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শুধু ঈদ নয়, থার্টি ফার্স্ট নাইটসহ সরকারি ছুটি ও বিভিন্ন উৎসবের সময় কুয়াকাটায় পর্যটকদের ব্যাপক আগমন ঘটে। তাই পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করে যাবে।