সাদা শিয়ালের চমক

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাদা শিয়াল l ছবি: লেখক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাদা শিয়াল l ছবি: লেখক

দীর্ঘদিন দূরের কোনো বন-বাদাড়ে দুর্লভ কোনো প্রাণীর খোঁজে যাওয়া হয় না। ঘরে বসে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ঘরের আশপাশে, অর্থাৎ সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়াব। এই এলাকায় এখনো অনেক বুনো ঝোপঝাড় আছে, তবে ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে শিক্ষকজীবন পর্যন্ত এত ঘোরাঘুরি করেছি যে এই এলাকায় চমক দেওয়ার মতো কোনো বন্য প্রাণী দেখার আশা করি না।
চলতি বছর ২০১৪ সালের প্রথম দিন আমার ছাত্র নাইমুস সাদাত রনিকে সঙ্গে নিয়ে বের হলাম ভর দুপুরে। বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন কিছু বুনো ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ শিয়ালের ঝগড়া করার খ্যাক-খ্যাক শব্দ পাওয়া গেল। শব্দ শুনে তাকিয়ে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলাম। ঝোপের পাশে তিনটি শিয়াল। তাদের একটি সম্পূর্ণ সাদা! সাদা শিয়ালটি অপর দুটো স্বাভাবিক শিয়ালের একটির সঙ্গে ঝগড়া করছে। পরমুহূর্তেই সাদা শিয়ালটি তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল অনেক দূর। এরপর বীরের বেশে ফিরে এল তৃতীয় শিয়ালের কাছে। বুঝতে পারলাম, এরা জোড়া বেঁধেছে। সাদা শিয়ালটি পুরুষ এবং আকৃতিতে তার সঙ্গিনীর তুলনায় কিছুটা বড়। আর সে এইমাত্র এক প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষ শিয়ালকে তার সঙ্গিনীর কাছ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এল। এরপর এক ঘণ্টার বেশি সময় এরা একসঙ্গে শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিল। সাদা পুরুষ শিয়ালটি কিছুক্ষণ পর পর তার সঙ্গিনীকে শুঁকছিল আর আদর করে সারা গায়ে মোলায়েম কামড় দিচ্ছিল। আমি বড় একটা কাঁঠাল গাছের পেছনে লুকিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করলাম, ছবি তুললাম এবং ভিডিও করলাম। এ এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
যেকোনো সাদা বা শ্বেতী বন্য প্রাণী (ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অ্যালবিনো’) প্রকৃতিতে খুবই দুর্লভ। আমার জানামতে, ইতিপূর্বে বাংলাদেশের কোথাও সাদা শিয়াল দেখার নজির নেই। যখন কোনো বন্য প্রাণীর (স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ, ইত্যাদি) ত্বকে রঞ্জক পদার্থ তৈরি হয় না, তখন ওই প্রাণীটি সাদা বা সাদাটে হয়ে যায়। এমনও হতে পারে যে প্রাণীটির কিছু অংশ সাদা আর কিছু অংশ স্বাভাবিক। আমাদের দেখা শিয়ালটি ছিল সম্পূর্ণ সাদা। তবে এর নাক ও মুখের উন্মুক্ত চামড়া ছিল গোলাপি এবং চোখ ছিল ধূসর রঙের। সাদা হলেও এর স্বাস্থ্য ছিল বেশ ভালো এবং আচরণও ছিল স্বাভাবিক। এর একমাত্র সমস্যা যেটি লক্ষ করেছি তা হলো, এটি বেশি আলোতে ভালোভাবে তাকাতে পারে না। সম্ভবত সে কারণেই সে দিনের আলোতে বাইরে বের হয় না এবং কোনো মানুষ তাকে সহজে দেখতে পায় না। পড়ন্ত বিকেলে যখন রোদ নরম হয়ে আসে, তখন সাদা শিয়াল আর তার সঙ্গিনী বিশ্রাম সেরে খাবার খুঁজতে বের হলো। আমিও তাদের পিছু পিছু চললাম, কিন্তু বেশিদূর আর নজরে রাখতে পারলাম না। সাদা শিয়ালটি ছোট একটা প্রাণী শিকার করল, এরপর সঙ্গিনীসহ হারিয়ে গেল ঘন জঙ্গলে।
সাভার এলাকার বুনো ঝোপঝাড় আর শিয়ালের পর্যাপ্ত খাবার যত দিন থাকবে, তত দিন এই সাদা শিয়াল তার সঙ্গিনী আর প্রতিবেশীরা টিকে থাকবে। শেয়াল হাঁস-মুরগি শিকার করে বলে মানুষ তাদের শত্রু বলে বিবেচনা করে। সুযোগ পেলে মারতে বা আহত করতে ছাড়ে না। কিন্তু শিয়াল যতটুকু ক্ষতি করে তার চেয়ে অনেক বেশি উপকার করে। এরা ফসলের জন্য ক্ষতিকর ইঁদুর এবং ঘাসফড়িং খেয়ে ফসল রক্ষা করে। আমাদের সবার উচিত শিয়ালের প্রতি সদয় হওয়া।