সামরিক বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তৃত্ব থাকা উচিত

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর ওপর অবশ্যই নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তৃত্ব থাকা উচিত। আর জাতীয় উন্নয়নে আরও ভূমিকা রাখার স্বার্থে বেসামরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্রের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা প্রয়োজন। বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের সম্পর্ক জোরদার করতে একটি রূপরেখা তৈরি করা জরুরি।
গতকাল বুধবার রাজধানীতে এক সেমিনারে বিভিন্ন বক্তা এই অভিমত দিয়েছেন। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ (এএফডি) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস—বিস) যৌথভাবে দিনব্যাপী এই সেমিনারের আয়োজন করে।
বিস মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘সিভিল-মিলিটারি রিলেশনস ইন ডেমোক্রেসি: অ্যান ইফেকটিভ ফ্রেমওয়ার্ক’ শীর্ষক সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী।
সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের রাষ্ট্রদূত ছাড়াও জ্যেষ্ঠ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, সাবেক কূটনীতিক ও গবেষকেরা সারা দিনের ওই সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন।
বিসের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মুন্সি ফয়েজ আহমেদের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের (এনডিসি) কমান্ডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দি। ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরণ সিং অনুপস্থিত থাকায় তাঁর পক্ষে প্রবন্ধটি পড়ে শোনান দিল্লির গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডিএসএর শ্রুতি পট্টনায়েক।
স্বাগত বক্তৃতায় বিসের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আবদুর রহমান বলেন, বিভিন্ন দেশে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা রকম সমস্যা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনের মধ্যে অপর্যাপ্ত তথ্য বিনিময়, উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বচ্ছতার অভাব, প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ, অব্যাহত দুর্নীতি এবং বেসামরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দি বলেন, ‘আমাদের অনেক দলিল, নির্দেশনাসহ সম্ভবত সবকিছুই আছে। কিন্তু সেগুলো কতটা দৃশ্যমান, এ নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের জাতীয় কমিটি থাকলেও তা কার্যকর নয়। এই কক্ষে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সম্ভবত অন্যরা জাতীয় নিরাপত্তানীতি হয়তো দেখেননি। কিছু দলিল অবশ্যই জনসমক্ষে আনা উচিত।’
জাতির জীবনে কোনো বিরাট সংকট তৈরি হলে তা মোকাবিলার কমিটি কোথায়, আর সিদ্ধান্তই বা কে নেবেন, এ নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন।
প্রসঙ্গত নবম জাতীয় সংসদে জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার খসড়া তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য ২০১১ সালের জুলাইতে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটিও গঠন করা হয়। পরে এ নিয়ে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক বলেন, ‘বাংলাদেশ যেমন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে, তেমনি এ দেশে যে দীর্ঘদিন অগণতান্ত্রিক শাসন চলেছে, এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। বিভিন্ন সময় জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি পরিবর্তন হওয়ায় তা জাতীয় নিরাপত্তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাই আজ আমরা দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের হুমকি দেখতে পাচ্ছি।’
তারিক আহমেদ সিদ্দিকের মতে, অতীতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাদের সংঘাতের কারণে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের বিষয়টি মনোযোগ কেড়েছে। অতীতে আমলাতন্ত্র, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং কখনো কখনো কূটনীতিকদের সহযোগিতা না পেলে সেনা নেতৃত্বাধীন শাসনের অস্তিত্ব থাকত না। কাজেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সুরক্ষায় সামরিক কর্মকর্তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। আর এই ভূমিকা বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কোন্নয়নে অবদান রাখবে।
গণমাধ্যমের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক নিয়ে বলতে গিয়ে মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক বলেন, ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে দমনকারী শক্তি হিসেবে দেখা হয়। তথ্য না জানার কারণে এমনটা হচ্ছে। দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) নামে আমাদের একটি সংস্থা আছে, যা পর্যাপ্ত নয়। আমি মনে করি, সংস্থাটি বিভিন্ন সময় শুধু বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে।’
বিসের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ ফিরদাউস মিয়ার সভাপতিত্বে প্রথম কর্ম-অধিবেশনে মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে স্বচ্ছতার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশের বেসরকারি খাত প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করে। তবে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে আমাদেরও সুযোগ দিতে হবে। ১ জুলাই-পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে সামরিক গোয়েন্দা সামর্থ্যের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।’
ওই অধিবেশনে আরও দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শ্রীলঙ্কার কোতেওয়ালা ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এম জয়াবর্ধানা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক রাশেদুজ্জামান।
সমাপনী অধিবেশনে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন তাঁর প্রবন্ধে বলেন, বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক নিয়ে বলাটা সেনাবাহিনীর কাজ নয়। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা কী বলছেন, তা শোনার জন্য এখানে যে কোনো জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদকে দেখা যাচ্ছে না, সেটি দুঃখের সঙ্গে বলতেই হচ্ছে। সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করবে সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। গণতন্ত্রে সবকিছুতে সামষ্টিক নিয়ন্ত্রণ থাকে। যদি তা এক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, একজনই যদি নীতি ও কৌশলের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, তবে চরম ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমরা নিরাপত্তাবিষয়ক জাতীয় কমিটির কথা জানি। ওই কমিটি কীভাবে কাজ করে, কমিটির সদস্য কারা, এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। প্রতিরক্ষাবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি কাগজে থাকলেও বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই।’
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত করে। কাজেই সামরিক বাহিনীকে অবশ্যই বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকতে হবে। বেসামরিক কর্তৃত্বের মাধ্যমে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। তবে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমারেখা ও স্বচ্ছতা থাকা উচিত। গুলশানের ঘটনা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।’
ওই অধিবেশনে সভাপতির বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বেসামরিক ও সামরিক পক্ষের উত্তেজনা কিন্তু বেসামরিক পক্ষগুলোর সংঘাতের কারণে সৃষ্টি হয়। আর এই উত্তেজনা অব্যাহত থাকলে সামরিক বাহিনী আসবে, বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন। গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পেশাদারত্বের অভাব আছে। সব ক্ষেত্রেই স্বজনপ্রীতি হচ্ছে। এ সমস্যার সমাধান জরুরি। তা ছাড়া সুশাসনের অভাব লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তাই কেউ পরিস্থিতির পরিবর্তন আনতে আগ্রহী নন। এ ছাড়া রাজনৈতিক আমলাতন্ত্র ও ব্যবসার মধ্যে একধরনের আঁতাত আছে। এই আঁতাত ভাঙাও সহজ নয়। কাজেই একটার পর একটা কাঠামো ভেঙে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরির কথা ভাবতে হবে। এ ছাড়া সন্ত্রাস দমনে বেসামরিক ও সামরিক শক্তিকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
ইমতিয়াজ আহমেদ আরও বলেন, ‘গুলশানে রেস্তোরাঁয় হামলায় সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। এ ধরনের আত্মঘাতী হন্তারকদের রুখতে পুরোপুরি ভিন্ন কায়দায় এগোতে হবে। কারণ, এরা তো যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। আর বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কোন্নয়নের স্বার্থে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করা জরুরি। ভারতসহ অনেক উন্নত দেশের নিরাপত্তা কাউন্সিল আছে, কিন্তু বাংলাদেশের নেই। আমরা একে-অন্যকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত আছি। কিন্তু এরা (জঙ্গিরা) যা করতে চায়, তার জন্য তৈরি আছে।’
সমাপনী অধিবেশনে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসন পরিচালনায় উদারতা ও স্বচ্ছতার পাশাপাশি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
সমাপনী অধিবেশনে আরও দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নেপালের সেনাবাহিনীর সাবেক চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নেপাল ভূষণ চাঁদ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দীন।